নতুন নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় নব্য জেএমবি
চরম নৃশংসতার মধ্য দিয়ে উত্থান হওয়া নব্য জেএমবি জননিরাপত্তার জন্য এখনো হুমকি হয়ে আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় জঙ্গি নিহত হলেও নতুন নতুন নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে এই গোষ্ঠী। এ মুহূর্তে এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে আছেন কামরুল ওরফে আসাদ। আরও ছদ্মনাম থাকতে পারে তাঁর।
নব্য জেএমবি গত রমজান মাসেও বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করেছিল বলে জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের সতর্কতা ও জঙ্গিবিরোধী টানা অভিযানের কারণে জঙ্গিদের সেই চেষ্টা নস্যাৎ হয়ে গেছে।
এ ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর একজন সাবেক সদস্য এবং হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর নামে আরেক জঙ্গিকে এখন হুমকি বলে মনে করছে কোনো কোনো গোয়েন্দা সংস্থা। নিরাপত্তা বাহিনীর ওই সাবেক সদস্য এখন নব্য জেএমবির সামরিক প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া সাগর সীমান্তের ওপার থেকে কালোবাজারে অস্ত্র-বিস্ফোরক সংগ্রহের চ্যানেলটা চেনে। তাই তার পক্ষে নতুন করে অস্ত্র-বিস্ফোরক সংগ্রহ সম্ভব।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী এবং তারপর আমিরের দায়িত্বে আসা সারোয়ার জাহান নিহত হওয়ার পর নেতৃত্বে আসেন রাজশাহীর মইনুল ইসলাম ওরফে মুসা। তাঁর নেতৃত্বে আইএস মতাদর্শ অনুসরণকারী এই গোষ্ঠী আবারও বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তারা হাতে তৈরি বোমা-গ্রেনেডের (আইইডি) নানা গবেষণা চালায় এবং নতুন ধরনের শক্তিশালী বোমা তৈরি এবং এর মজুত গড়ে তোলে। তারা হামলার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণের জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) পর্যবেক্ষণও (রেকি) করেছিল। এ ছাড়া বিদেশি নাগরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও হামলার পরিকল্পনা করেছিল বলে জানা যায়।
অবশ্য ঘটনাচক্রে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লায় আহমেদ আজওয়াদসহ দুই জঙ্গি ধরা পড়ার পর গত মার্চে সীতাকুণ্ডের জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। সেখানে জঙ্গিরা শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের নতুন করে প্রস্তুতির খবর জানতে পারে। এরপর সিলেট, মৌলভীবাজার, রাজশাহী ও ঝিনাইদহে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। জঙ্গিরা ওই সব আস্তানায় বোমা ও বিস্ফোরকের মজুত গড়ে তুলেছিল। তারা এসব স্থানে বোমা তৈরি করে তা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে জড়ো করছিল। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই সব আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, তামিম চৌধুরীসহ হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় জড়িত অনেককে বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল, নব্য জেএমবি বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। খুব শিগগির আর সংগঠিত হতে পারবে না। কিন্তু এত দ্রুত জঙ্গিরা যে আবার সংগঠিত হয়ে নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কুমিল্লায় আজওয়াদ ধরা না পড়লে তা টের পেতে আরও সময় লাগত। তত দিনে হয়তো এরা আরও অনেক শক্তি সঞ্চয় করে ফেলত।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জঙ্গিদের হয়তো এই রমজানকে কেন্দ্র করে একটা প্রস্তুতি ছিল। গত মার্চ থেকে টানা অভিযানে তাদের সেই সক্ষমতাটুকুও পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
নব্য জেএমবির উত্থান সম্পর্কে জানা যায়, ২০১৩ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী এ দেশে আসেন। এরপর তিনি পুরোনো জেএমবির কিছু লোককে নিয়ে আইএস মতাদর্শ অনুসরণকারী নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। দুই বছরের মাথায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের শুরু থেকে দেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে তারা। একের পর এক বিদেশি নাগরিক, খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী, হিন্দু পুরোহিত, শিয়া হত্যা এবং আহমদিয়া ও শিয়া মসজিদে হামলা চালায়। আর এসব ঘটনার দায় স্বীকার করে আইএস। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার আইএসের এসব দাবি নাকচ করে আসছে শুরু থেকেই। পুলিশ বলছে, এই নতুন জঙ্গিগোষ্ঠীর নাম নব্য জেএমবি। আর র্যাব বলছে জেএমবির সারওয়ার-তামিম গ্রুপ। যদিও তামিম চৌধুরী এ দেশে আসার আগেই সিরিয়া-ইরাককেন্দ্রিক আইএসের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল, যা কানাডার সংবাদপত্রসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এর আগে খবর বের হয়।
হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা ঠেকাতে না পারলেও এরপর অল্প দিনের মধ্যে এই গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিভিন্ন আস্তানায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব অভিযানে তামিম চৌধুরীসহ নব্য জেএমবির তখনকার প্রায় সব শীর্ষ নেতা নিহত হন। যাঁদের মধ্যে আটজন হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর নব্য জেএমবির নেতৃত্বে আসেন সারওয়ার জাহান ওরফে মানিক। তাঁর নেতৃত্বে এই গোষ্ঠীটি আবার সংগঠিত হতে শুরু করে। অক্টোবরে সাভারে র্যাবের অভিযানে নিহত হন সারওয়ার জাহান। এরপর নব্য জেএমবির নেতৃত্বে আসেন মইনুল ইসলাম ওরফে মুসা। তাঁর নেতৃত্বে নব্য জেএমবি আবার ভয়ংকর রূপে আত্মপ্রকাশের প্রস্তুতি নেয়। নতুন করে সদস্য সংগ্রহ করে বলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে খবর আছে। বিশেষ করে গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে তারা বেশ কিছু সদস্য সংগ্রহ এবং সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটায়।
অবশ্য কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এদের বিস্তৃতিটা ভয়াবহ পর্যায়ে যায়নি। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে নব্য জেএমবির নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল পুলিশ। যারা বাকি ছিল তারা আবার ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সংগঠিত হচ্ছিল। পরে টানা অভিযানে তাদের আবার বিপর্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, হোলি আর্টিজান বেকারির ঘটনার পর জঙ্গিদের একমাত্র সফল হামলা হয় সিলেটে।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ মার্চ সিলেটের আতিয়া মহলে সেনা কমান্ডোদের অভিযান চলাকালে অদূরে বোমা হামলা করে র্যাবের গোয়েন্দাপ্রধান, এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ সাতজনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। এর আগের দিন সন্ধ্যার পর ঢাকায় বিমানবন্দর সড়কের গোলচত্বরে পুলিশের তল্লাশিচৌকির কাছে আরেক জঙ্গি নিজের শরীরে বাঁধা বোমা বিস্ফোরিত হয়ে মারা যায়। নিহত জঙ্গি লাগেজ বোমা (লাগেজের ভেতরে বিশেষভাবে তৈরি শক্তিশালী বোমা) বহন করছিল। এর আগে ১৭ মার্চ আশকোনায় র্যাবের ব্যারাকে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সিলেটের আতিয়া মহলে বসে জঙ্গিরা লাগেজ বোমা তৈরি করে। মৌলভীবাজারের বড় হাটের আস্তানায় পুলিশের অভিযানে অন্য জঙ্গিদের সঙ্গে মুসাও নিহত হন। মুসা বিস্ফোরক সংগ্রহ ও শক্তিশালী বোমা তৈরি ও মজুত গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এমনকি গাড়িবোমার প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। এর আলামতও পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুসার মৃত্যুর পর নব্য নেতৃত্বে আসেন আইয়ুব বাচ্চু। তিনি নতুন আমির। গতকাল পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আইয়ুব বাচ্চুসহ গুলশান হামলা মামলার পলাতক পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশসহ অন্যান্য গোয়েন্দা কাজ করছে। অচিরেই হয়তো গ্রেপ্তার হবে তারা।
তবে একটি গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা গেছে, আইয়ুব বাচ্চু ওরফে মামুন ওরফে হাবিবুর রহমান ঢাকার একটি কলেজে লেখাপড়া করেছেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমে তাঁর নাম ব্যাপকভাবে এসেছে। জানা গেছে, এরই মধ্যে নব্য জেএমবির নেতৃত্বে নতুন একজন এসেছেন। তাঁর নাম কামরুল ওরফে আসাদ।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি সূত্র জানায়, মুসার মৃত্যু এবং তার আগে-পরে সীতাকুণ্ড, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ঝিনাইদহে অভিযানের পর নব্য জেএমবির শক্তি-সামর্থ্য অনেক কমেছে। নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হয়েছে। এখন যাঁরা নেতৃত্বে আছেন, তাঁরা সবাই অল্প বয়স্ক। মুসা চারজন বোমার কারিগর তৈরি করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন নিহত হয়েছেন—একজন সীতাকুণ্ডে (শোয়েব), একজন মৌলভীবাজারে (মোশাররফ হোসেন) ও আরেকজন আতিয়া মহলে। এখন জীবিত আছেন একজন।
ওই সূত্র আরও জানায়, নব্য জেএমবির কাছে এ মুহূর্তে হামলায় অংশ নেওয়ার মতো সদস্য কম আছে। ১৫ থেকে ২০ জন হতে পারে। তারা কথিত হিজরতের নামে ঘর ছেড়েছে অনেক আগে। তবে নব্য জেএমবির এখনো বেশ কিছু সমর্থক বা শুভানুধ্যায়ী রয়ে গেছে। এই সংখ্যা কয়েক শ হতে পারে। অবশ্য সাধারণ সমর্থকদেরও অল্প দিনের মধ্যে ভয়ংকর জঙ্গিতে পরিণত করতে পারে উগ্রবাদী সংগঠনগুলো। ছোটখাটো সদস্যও হঠাৎ নেতা হয়ে উঠতে পারেন। এমন উদাহরণ আছে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন জঙ্গিদের হোলি আর্টিজানের মতো বড় হামলা করার মতো শক্তি, সামর্থ্য বা মনোবল—কোনোটিই নেই। তারা বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে। আমরা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। আশা করি, পর্যায়ক্রমে বাকি জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হব।’