নদীকূলে নিঃস্ব, তবু রাজ উৎসবের জীবন

২০২০ সালে বাঁধে বসতির সময় কপোতাক্ষে নৌকায় হিরা মণ্ডল
প্রথম আলো

নির্মল হাসির শক্তি জীবনের চূড়ান্ত দীনতাকে ম্লান করতে জানে। খুলনা কয়রার উত্তর বেদকাশিতে কপোতাক্ষ নদের উদর গত দেড় বছর ধরে স্ফীত। ঝড়ের আঘাতের ক্ষত বুঝতে সময় প্রয়োজন। কপোতাক্ষের বুকে প্রমাণ রেখে গিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান।

আর এই কপোতাক্ষের পাড় ধরে আছে হাজারো মানুষের লড়াইয়ের যন্ত্রণা। এ নদ ঝড়ের আগে এখনকার অর্ধেকও ছিল না। সরু সরু খাল আরও পুষ্ট করেছে কপোতাক্ষকে। উত্তর বেদকাশিতে দিঘির পাড় থেকে কাশির হাটখোলা যেতে নৌকা ভাড়া ২০ টাকা। নৌকা কখনো স্রোতের টানে তরতরিয়ে আগায়, কখনো তলায় ঠেকে যায় পুরোনো বাড়ির ভিটার উজিয়ে থাকা মাথায়। এখানেই কোথাও ছিল নদীমুখো ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান। কাচের বাক্সে সাজানো দানাদার, গজা বা কমলা রঙের আমিত্তির মতো সস্তা সেসব মিষ্টির গায়ে হয়তো কখনো মাছি বসত, ধুলা উড়ত অথবা স্কুলফেরত ছাত্র দুই টাকায় কিনত একটি মিষ্টি। সে দোকানে ঘরে তৈরি ডাল-ভাতও বিক্রি হতো এক কোনায়। হিরা আর বিশ্বজিৎ দম্পতি স্বপ্ন দেখছিলেন, পাঁচ বছরের সন্তান পূজার সঙ্গে সঙ্গে বড় হবে দোকানটাও। একদিন বসার জায়গা হবে দুটো টানা বেঞ্চিতে।

ক্রেতা বাড়লে খুলনা থেকে আরও ভালো মিষ্টির নমুনা এনে বানাবে। বাড়াতে হবে দুধ, চিনি আর ঘিয়ের জোগান। ব্যবসাটা বুঝে নিতে পারলেই রোজ রোজ দুই বেলা নদীর নোনাপানিতে নেমে নেটের জাল টেনে বাগদার পোনা খুঁজতে হবে না। কাদামাটির গর্তে কাঁকড়ার লোভে হাত দিলে বেরিয়ে আসবে না মাথা মোটা এক ঢোঁড়া সাপ। পূজার পড়ালেখার খরচ মিটেও হয়তো আরও একটু একটু সঞ্চয় হবে তাদের। অথবা সপ্তাহে একটা দিন মাংস–ভাতের সুখস্বপ্ন।

২০২০ সালের মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহের একদিন দুপুর থেকে জোর হাওয়া বয়ে গেল। সামান্য কিছু গুছিয়ে তোলার আগেই চোখের সামনে থেকে কে যেন এক টানে সরিয়ে নিল মাটির উঠানটা। এ উঠানের একপাশে বড় তিনটি আমগাছ, দুটো ছোট পেয়ারাগাছে সদ্য সাদা ফুল হাসছে শিশুর দুধ দাঁতের মতো। প্রথমে বাতাসে চাল উড়ল তারপর পাতার মতো কাঁপতে থাকল দোকানের টিনের বেড়া। যমে মানুষে টানাটানির মতো বাতাস–টিনে টানাটানি চলল কিছুক্ষণ। সব গল্প বদলে গেল মুহূর্তে। তলা থেকে চাক ধরে ধরে মাটি কেড়ে নিল কপোতাক্ষ। সামান্য একটা ঢোঁক গেলার শব্দের মতো শব্দ উঠল। কপোতাক্ষ টুক করে গিলে ফেলল সেই মিষ্টির দোকান। যে দোকান বড় হচ্ছিল পূজা নামের এক শিশুর সঙ্গে সঙ্গে।

আম্পানে দক্ষিণাঞ্চলের হাজারো মানুষের স্বপ্ন এভাবেই বিলীন হয়েছে নদীতে। তারও আগে ফণী, বুলবুল, আইলা বা সিডর কোনোটাই ছাড় দেয়নি এ অঞ্চলের মানুষকে। দক্ষিণ বেদকাশির লিটন বলেছিল, আইলার সময় তারা শাড়িতে বাঁধা মা আর শিশুর শরীর ভেসে যেতে দেখেছে। তখন তারা নিজেরাই বেঁচে আছে নারকেলগাছ আঁকড়ে ধরে।
কাশির হাটখোলা বেড়িবাঁধে সারি সারি ঘরের ভেতর একটা তাঁবুর ঘর টাঙিয়েছিল হিরা। খাওয়া, বসা, ঘুম একই জায়গায়। সে ঘর বৃষ্টির পানিতে ভাসে, রোদে শুকায়।

কপোতাক্ষ শুধু ঘর নেয়নি, নিয়েছে জমি ও স্বপ্নও। ফলে হিরারা আম্পানের আঘাতে দক্ষিণাঞ্চলের হাজারো বাস্তুহীনদের একজন। যারা বাঁধের দাবিতে গলাসমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে। স্থায়ী বাঁধের ক্ষতির দিকটা তারা জানে না। ঘেরের মানুষ বাঁধ কেটে নোনাপানি প্রবেশ করায় চোখের সামনে দেখলেও এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ভাবার মতো আর্থিক অবস্থা এখানকার দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের নেই। সাতক্ষীরা, আশাশুনি, কয়রা অঞ্চলে ঝড়ের আট মাস পরের পরিস্থিতি দেখতে প্রথম আলোর দুজন সংবাদকর্মী গিয়েছিলাম। বাঁধের দাবিতে তখন সোচ্চার মানুষ। বুকে প্ল্যাকার্ড লেখা, বাঁধ চাই। দাঁড়িয়ে আছে কোমরপানিতে। কয়রার দিঘিপাড় থেকে নৌকায় ওঠার সময় একটি শিশু রোদের তাপ থেকে বাঁচতে আমার শরীর ঘেঁষে বসেছিল। তাকে ছাতার আশ্রয়ে আনতে টানতেই ওর মায়ের মিষ্টিমুখের হাসি। মায়েরা আজীবন সামান্যতেই কৃতজ্ঞ। অপরিচিত এক শহুরে নারী তাঁর সন্তানের কথা ভেবে ছায়া ধার দিল বলে তিনি উপহার দিলেন অকপট আনন্দের হাসি। তরুণীর কপালের সিঁদুরের টিপ ঘামে লেপ্টে আছে। গলায় তুলসীর মালা ভিজে গাঢ় রঙের হয়েছে। হাতার কাছে সামান্য ছেঁড়া লাল ব্লাউজটা ঢাকতে ঘোমটা টানলেন বড় করে। জানালেন বাঁধে তাঁদের বসতি।

কপোতাক্ষ আড়াআড়ি পার হয়ে আমরা উঠলাম সেই বাঁধে। হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ভিড়ে হারিয়ে গেলেন মেয়ের হাত ধরে ওই নারী। বলে গেলেন, যেন তাঁদের বাড়ি যাই।

ঋণ করে কেনা গোলপাতায় সরকারি জমিতে হিরার বর্তমান ঘর
সংগৃহীত

যদিও কোথায় তা জানতে চাওয়া হয়নি। সারা দিন কাজ শেষে পুরো বাঁধ ঘুরে ফিরতে ফিরতে ভাটা শেষে জোয়ার এসেছে। নৌকায় ওঠার আগমুহূর্তে সকালের সেই পরিচিতি মুখটা হঠাৎ দেখা। এক তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বিস্তৃত এক হাসি উপহার দিয়ে বললেন, ‘সারা দিন রোদে রোদে ঘুইরে কাজ করতিছেন দেখলাম। দুপুরে খাইছিলেন? যা আছে তাই দিয়ে দুটো মুখী দি যান।’ আশ্চর্য ব্যাপার, তিনি জানেন আমাদের বহরে চারজন (স্থানীয় দুজনসহ), তবু আন্তরিকতারই নিমন্ত্রণ। এবার প্রথম ভালোভাবে খেয়াল করলাম, পূজার মা সন্তানসম্ভবা। তখনো খুব স্পষ্ট না সবটা। ফোন নম্বর চেয়ে নিলাম তাঁর স্বামীর। ফিরতি পথে আবার দেখা বলে তাঁর মনে বন্ধুত্বের মায়া মন্ত্র। সংকোচে অপ্রকাশ্য। ফেরার পথে বাঁধের শত নারী ভিড় করছিলেন বিদায় জানাতে। একজনেরই চোখে–মুখে বিচ্ছেদের বেদনা। তরুণী মা হিরা মণ্ডল।

বহুদিন পর সে নম্বরে ফোন দিলাম খবর নিতে। আদতে আমার ইচ্ছা বাঁধের বসতির বর্তমান পরিস্থিতির খবর পাওয়া। বাঁধ তো আটকানো হয়েছে কিছুদিন হলো। জানলাম, বাঁধ হলেও উত্তর বেদকাশির গাতির ঘের আর মহারাজপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ দশালিয়া পয়েন্ট দিয়ে আবার প্রবেশ করছে কপোতাক্ষের পানি। এত দিন পর ফোন পেয়ে হিরার কণ্ঠে এতটুকু কমতি নেই উৎসাহের। জানালেন, একটি বোন হয়েছে পূজার। এই ভাদ্র মাসে তার চার মাস হলো। বাকি বৃত্তান্ত পাঠককে আহত করতে পারে। বাঁধ থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশের পর তাঁদের ফেরার আর কোনো জায়গা ছিল না। খাসজমিতেই ঘর তুলেছেন। সে ঘর মানে গোলপাতার খানিকটা ছাউনি। ঘরের খুঁটির একটি অংশ শূন্যে ঝুলে আছে, যার তলায় বইছে কপোতাক্ষ। এই গোলপাতা কিনতে হয়েছে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। ছয় পণ পাতা কিনতে ঋণ করতে হয়েছে মহাজনের কাছে। বাঁধের কাজে হিরার স্বামীর কাজ পাওয়ার কথা থাকলেও অনিয়মিত মজুরি এবং তাই নিয়ে বিদ্রোহের জেরে তাঁকে কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি দিনমজুর। স্থানীয় ভাষায় হাজেরা মজুরি খাটেন, তা–ও তা ভীষণ অনিশ্চিত। দুই চোখে ত্রিসীমানায় যেখানে শুধু নোনাপানি ছাড়া আর কিছুই নেই, সেখানে কে করাবে মজুরের কাজ! চাল কিনতে গত মাসে আবার কর্জ হয়েছে ২ হাজার ২০০ টাকা। আগের আরেক ধারের টাকা শোধ করতে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ধার নিয়েছিলেন ২ হাজার ৫০০ টাকা। এসব টাকার জন্য প্রতি মাসে হাজারে ৫০ টাকা করে সুদ দেন হিরা-বিশ্বজিৎ। চুলায় আগুন পড়ুক বা না পড়ুক, মাস শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হয় মহাজনের তাগাদা। পরপর দুদিন ডালে কচু ঘোটা দিয়ে ভাত খেয়ে অভিমানে খাওয়া বন্ধ করেছে ছোট্ট পূজা।

কোলের চার মাসের শিশুটির নাম জুঁই। ওকে বড় দিদির জিম্মায় রেখে এখন দুই বেলা বাগদা চিংড়ির পোনা খুঁজতে কপোতাক্ষে নামেন হিরা। এতটুকু দুই শিশু ঘরে রেখে যান। ঘর বলতেও তো সেই শুধু গোলপাতার ছাউনি। এক–দুই টানে ছোট নেট জালে ৮০ থেকে ৯০টি করে পোনা পান। তুলে এনে সেসব আলাদা করতে হয় ঝিনুকে তুলে।

কপোতাক্ষের পাশে হিরার পরিত্যাক্ত মিষ্টির দোকান।
সংগৃহীত

বাকি পানিতে থাকা অন্য মাছের পোনা আবার ছেড়ে দিয়ে আসতে হয় নদীতে। সব মিলিয়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার ফের। সারা শরীর ভিজে থাকে নোনাপানিতে। হাত-পায়ের আঙুলের ফাঁকে ঘা হয় মাঝে মাঝে। আগুনে শর্ষের তেল গরম করে ডললে কিছুক্ষণের জন্য নিরাময়। দুটো পোনা বিক্রি হয় এক টাকার বিনিময়ে। অর্থাৎ সদ্য মা হওয়া এ নারীর নোনাপানিতে ভিজে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার পরিশ্রমে উঠে আসে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। গর্ভবতী নারীদের সরকার কার্ডের বিনিময়ে মাসে মাসে কিছু টাকা দিয়ে থাকে। সে কার্ড পেতেও স্থানীয় এক দালালকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এসব নিরন্তর অভাবের কথা শুনতে শুনতে হিরা মণ্ডলের সেই হাসিমুখ ভেসে ওঠে। হিরা পাল্টা জানতে চাইলেন, ‘এত রাতে আপনার ওই পাশে এমন শব্দ হতিছে কিসের?’ বললাম, এখনো অফিস করি। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘আহা রে এত রাত্তির পর্যন্ত খাওয়ার জন্য কাজ করতি হয়। আপনি ভাত খাইয়েছেন? আবার কবি দেকতি পাব? একবার আসেন এট্টা দিন থাইকে যান আমার নতুন ঘরে। নদীতে মাছ ধইরে খাওয়াব।’

ছবি তোলার মতো কোনো যন্ত্র হিরার কাছে নেই। কয়রার উত্তর বেদকাশির কাশির হাটখোলার পবিত্র সরকারকে অনুরোধ করে কিছু ছবি পাওয়া গেলে হিরা আর চার মাসের জুঁইয়ের। পেছনে তাঁদের সেই গোলপাতার ঘর, মহাজনের কাছে যার মূল্য পরিশোধের আগেই যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে কপোতাক্ষের বুকে। তাঁর সেই ঘরের ছবি মনে করে আতঙ্কিত হই। তবু এই সত্যিকার নিমন্ত্রণ বার্তা দেয়, নিঃস্ব মানুষের বুকের ভেতরও থাকতে পারে এক রাজার ভান্ডার।