নয় নারীর বিপরীতে পুরুষ ব্যবহারকারী মাত্র একজন

দেশে নয়জন নারীর বিপরীতে মাত্র একজন পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার বাড়লেও পুরুষের অংশগ্রহণ সেভাবে বাড়েনি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, পদ্ধতি গ্রহণেপুরুষ ও নারীর অনুপাত ১:৯।

জন্মনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বেশির ভাগই নারীর ওপর চাপানোয় তাঁদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও সহ্য করতে হচ্ছে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণের যেসব পদ্ধতি নারীরা গ্রহণ করেন, এর প্রায় প্রতিটিরই কমবেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। অন্যদিকে কনডম ও স্থায়ী পদ্ধতি ছুরিবিহীন ভ্যাসেকটমি (এনএসভি) পুরুষদের মধ্যে কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না।

১৯৭৫ সালে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করতেন মাত্র ৮ শতাংশ দম্পতি। বর্তমানে এর হার ৬১ শতাংশে উঠেছে। তবে পুরুষের অংশগ্রহণ সেভাবে বাড়েনি।

সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১১ বলছে, ১৯৭৫ সালে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ কনডম ব্যবহার করতেন। বর্তমানে তা হয়েছে ৬ শতাংশ। একই সময়ে খাওয়ার বড়ি ব্যবহারকারী নারীর হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭ শতাংশ। বর্তমানে এটি সর্বোচ্চ ব্যবহূত পদ্ধতি।

অনাকাঙ্ক্ষিত পিতৃত্ব ঠেকানো ছাড়াও এইডসসহ বিভিন্ন যৌনবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও পুরুষেরা কনডম ব্যবহার করে থাকেন। ফলে এই অস্থায়ী পদ্ধতি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কতটুকু ভূমিকা রাখছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন।

বিডিএইচএসের ২০১১ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে বর্তমানে নারীর স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের হার ৫ শতাংশ এবং পুরুষের স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের হার ১ দশমিক ২ শতাংশ। ১৯৭৫ সালে পুরুষের ক্ষেত্রে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।

তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণকারী পুরুষের হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। কনডম ব্যবহারকারীর হার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এ প্রতিবেদনের মতে, পুরুষের অংশগ্রহণ খানিকটা বেড়েছে, তবে নারীদের পদ্ধতি ব্যবহার তার তুলনায় বেশি বেড়েছে।

স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণকারী পুরুষের হারের বিষয়ে বিডিএইচএসের পরিসংখ্যানের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসাবের বড় ধরনের ব্যবধান নিয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তর বলেছে, সমীক্ষার জন্য জিজ্ঞেস করা হলে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণকারী অনেক পুরুষ সংকোচের কারণে তা স্বীকার করেন না। কিন্তু অধিদপ্তর তাদের কাছে সেবাগ্রহণকারী পুরুষদের বিষয়ে মাঠপর্যায় থেকে তথ্য নিয়ে হিসাব করে থাকে।

নারীর পদ্ধতিতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: প্রচলিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বেশির ভাগই নারীর জন্য তৈরি। মোট সাতটি পদ্ধতির মধ্যে মাত্র দুটি পুরুষের জন্য। নারীদের জন্য রয়েছে লাইগেশন, আইইউডি, ইমপ্ল্যান্ট, ইনজেকশন ও বড়ি। স্থায়ী পদ্ধতি লাইগেশন (টিউবেকটমি) করতে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের ছোট অস্ত্রোপচার লাগে।

আইইউডি ও ইমপ্ল্যান্ট দীর্ঘমেয়াদি অস্থায়ী ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি। আইইউডি জরায়ুতে স্থাপন করতে হয়। অন্যদিকে ইমপ্ল্যান্ট পদ্ধতিতে একটি বা দুটি নরম অতি ক্ষুদ্র ক্যাপসুল কনুইয়ের ওপরে চামড়ার নিচে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ইনজেকশন হচ্ছে আরেকটি ক্লিনিক্যাল ও অস্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি। এটি প্রতি তিন মাস পর পর নিতে হয়। এ ছাড়া আছে খাওয়ার বড়ি। আইইউডির ক্ষেত্রে প্রথম কয়েক মাস তলপেটে ব্যথা ও ফোঁটা ফোঁটা রক্তস্রাব হতে পারে। ইমপ্ল্যান্ট ও ইনজেকশনের কারণে মাসিকে পরিবর্তন, মাথাব্যথা ও ওজন বেড়ে যেতে পারে। নারীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি খাওয়ার বড়ি গ্রহণের ফলে মাসিকের পরিমাণ কম হওয়া এবং সন্তান প্রসবের পর বুকের দুধ কম হওয়ার মতো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উদাহরণ আছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুরুষদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার বাড়লে নারীদের ওপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চাপ কমতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নারী প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন বড়ি খাওয়া খুবই ঝামেলার। এক দিন খেতে ভুলে গেলে আবার নতুন নিয়ম মানতে হয়।

অনিরাপদ বা অপরিকল্পিত গর্ভধারনের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাৎক্ষণিক জরুরি পদ্ধতিও নারীকেই ব্যবহার করতে হয়।

পুরুষদের জন্য সহজতর: পুরুষদের জন্য প্রচলিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তুলনামূলক সহজ। একটি স্থায়ী ও একটি অস্থায়ী। পুরুষদের জন্য স্থায়ী পদ্ধতি হচ্ছে ছুরিবিহীন ভ্যাসেকটমি (এনএসভি)। পাঁচ থেকে সাত মিনিটের ছোট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সহজেই এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন পুরুষেরা। এ অস্ত্রোপচারে কাটা বা সেলাই লাগে না। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।

কনডম পুরুষদের জন্য অস্থায়ী পদ্ধতি। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এর ব্যবহারে যৌন রোগসহ এইচআইভি/ এইডস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু কনডম ব্যবহারে পুরুষের ব্যাপক অনীহা রয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোনো দম্পতি স্থায়ী পদ্ধতি নিতে চাইলে তা স্বামী নিলে সবচেয়ে ভালো হয়। কেননা, নারীদের স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয় পেট কেটে। অন্যদিকে পুরুষের এ পদ্ধতি গ্রহণ অনেক সহজ। অনেকেই ভাবেন, পুরুষেরা স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করলে পুরুষত্ব হারাবেন। এ কথার কোনো ভিত্তি নেই।