নানান বরণ ভাষা

>

নানান নৃগোষ্ঠীর বাস বাংলাদেশে। ভিন্ন তাদের ভাষা-সংস্কৃতি। মাতৃভাষায় লেখালেখির মধ্য দিয়ে আপন আপন সংস্কৃতি বারবারই তুলে ধরেছেন তাঁরা। বাংলাদেশে বসবাসকারী বিচিত্র নৃগোষ্ঠীর কয়েকজন কবির কবিতার অনুবাদ।

চাকমা ভাষা

সুহৃদ চাকমা

রাঙামাটি

অনুবাদ: মৃত্তিকা চাকমা

আমার আকাঙ্ক্ষার রাঙামাটি

সন্ধ্যার জুমের মাথায় কুপড়ি পিঠে দাঁড়ানো জুম্মবীর চোখের মতো;

জীবনের পিছল-আশার সুখস্বপ্নগুলো দু-চোখে মিতালি করে।

আমার আকাঙ্ক্ষার রাঙামাটি,

ঝরনাচুল-তালাকী যুবতীর বিচিত্র আশার মতো;

অফুরান ইচ্ছার বরদেবতা বিয়েত্রার নিত্য মিলন

পূর্ণিমা বুকের বাগানে কামুক-প্রজাপতি প্রেমের আলপনা আঁকে।

আমার আকাঙ্ক্ষার রাঙামাটি,

অঘ্রানের কাশফুলের ঘোমটা দেওয়া থুত্থুড়ে বুড়ি;

অজানা আনন্দে ঘোমটা দীপক রাগিণীতে নেচে ওঠে

রাধামন-ধনপুদি পালার শেষ-প্রহরের উল্লাসে।

আমার আকাঙ্ক্ষার রাঙামাটি,

প্রতিদিন ছড়ানো-ছিটানো লালমোরগ ফুলে সাজানো নববধূ;

বানভাসা উচ্ছ্বাসে ঠোঁট দুটি কেঁপে কেঁপে ওঠে

স্বপ্ন-কামনায় সন্তান সৃষ্টির মিষ্টি ইশারায়।

টীকা: জুম—গভীর বনাঞ্চল পুড়িয়ে চাষাবাদ করার পদ্ধতি।

জুম্ববী—জুম চাষার ঘরনি।

বিয়েত্রা—গঙ্গাদেবীর পুত্র, চাকমাদের বিয়ের অন্যতম দেবতা।

ধনপুদি-রাধামন—ধনপুদি গীতিকাব্যে বর্ণিত নায়িকা ও রাধামনের প্রেমিকা; চাকমাদের প্রেম ভালোবাসা ও সুন্দরের মিথ।

মণিপুরি (মীতৈ) ভাষা

সনাতন হামোম

কেঁদো না মা তুমি

অনুবাদ: সাজ্জাদুল হক স্বপন

কেঁদো না মা তুমি

অভিমান করো না মা তুমি,

ওরা মায়ের ভাষা শিখছে

মীতৈ বর্ণমালা ভালোবেসেছে।

ওঠো মা তুমি

দৃষ্টি দাও মা তুমি,

তোমার সন্তানেরা মীতৈ স্কুলে যাচ্ছে

মীতৈ বর্ণমালা শিখছে।

হাসো মা তুমি

আনন্দ করো মা তুমি,

মীতৈ বর্ণমালা শিখে

মায়ের ভাষায় কথা বলে

‘কংলৈচা’ সত্যি হবে ভাবছে ওরা দৃঢ় বিশ্বাসে।

মীতৈ মণিপুরি—এ-ই আজ ওদের গর্বিত পরিচয়।

টীকা: কংলৈচা—মীতৈ শব্দ, বাংলা অর্থ মণিপুরের অধিবাসী

সাঁওতালি ভাষা

বাসন্তী মুরমু

বাংলাদেশ প্রিয় মাতৃভূমি

অনুবাদ: খোকন সুইটেন মুরমু

বাংলাদেশ প্রিয় মাতৃভূমি।

সাঁওতাল কৃষক চাষাবাদ করে,

বাবা-মা ও পরিবার-পরিজন নিয়ে।

বৃষ্টি নামলে কাস্তে-কোদাল, হালের বলদ নিয়ে

মাঠে নামে সাঁওতাল কৃষক।

চাষ করে সবুজ শস্য ফলায়।

শস্যের বীজ বপন ও পরিচর্যা

এবং দিন শেষে সোনার ধান

গোলায় তোলা, কত আনন্দ!

নতুন ধানের গন্ধ,

ঋণ-মহাজন বস্তা নিয়ে ছোটেন

সাঁওতালের ঘরে।

দিন-রাত সমান করে,

মেপে নেন সব ধান সুদে-আসলে।

বাংলাদেশ প্রিয় মাতৃভূমি।

সাঁওতাল কৃষক চাষাবাদ করে,

বাবা-মা ও পরিবার-পরিজন নিয়ে।

তাঁর অবস্থা আদতে অপরিবর্তিত

বরং দিনকে দিন হচ্ছে খারাপ।

নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশে

পরিত্রাণের দিন গোনেন

সাঁওতাল কৃষক।

মারমা ভাষা

মং সিং ঞো

সভ্যতার পবিত্র পাগল

অনুবাদ: হাফিজ রশিদ খান

স্বপ্নের ফসলে দুঃস্বপ্নের সহস্র পাখির ঝাঁক

জেঁকে বসে জুমখেতে।

চিরহরিৎ বনের বাঁশ কেটে-কেটে

ভেলা সাজিয়েছে

সভ্যতার পবিত্র পাগল।

দড়ি-ফাঁস লাগিয়ে বাঁশের ভেলা

টেনে নিয়ে যায় নদীর উজানে।

প্রতিকূল স্রোতে জাতিস্মর এক চাষা

চেতনার চিরায়ু চেরাগ হাতে

ইতিহাসের মুখাবয়বে এঁকে দিল একটি আকৃতি;

অগ্নিতপ্ত সোনালি ধারণা ছিল যার মধ্যে।

ত্রিপুরা (ককবরক) ভাষা

বরেণ ত্রিপুরা

পাহাড়ে বসন্ত

অনুবাদ: মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা

এই পাহাড়ে প্রিয়া গান গায়

ওই পাহাড়ে সুর বয়ে যায়

মাঝখানে ওই চঞ্চলা ঝরনা

                রুমঝুমিয়ে নেচে চলে যায়

ও বুনো ফুল, সুবাসী বকুল

বনহরিণী প্রেমেতে ব্যাকুল

রঙিন ফাগুন লতায়-পাতায়

রং মাখিয়ে মন যে মাতায়

মন মাতানো প্রেমের কথা

                চুপি চুপি কে বলে যায়।

ফুলের সুবাস প্রেমের বাতাস

                থেকেই গেল সব অজানা

আমার মতো অধম ভ্রমর

                কি আর বুঝি সব ছলনা

দূর আকাশে মেঘের সাথে

উদাসী হাওয়া যায় যে বয়ে

বনের ফুলে দুলিয়ে দিয়ে

                চুপিসারে গান গেয়ে যায়।

মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ভাষা

রণজিৎ সিংহ

এসো আজ নতুন যাত্রায়

অনুবাদ: শুভাশিস সিনহা

এসো আজ, ধরো হাতে হাত

পুবে সূর্য উড়িয়েছে আলোর পতাকা,

ঘুম ভেঙে পাতো কান

কোথাও বেজেছে শঙ্খধ্বনি,

পৃথিবীর অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়েছে আলো

পাখিগুলো মনের আনন্দে

গেয়ে উঠছে গাছের শাখায়,

কেউ যেন বাদ পড়ে না যায় যাত্রায়,

এ জগতে আমরাও আছি—

এ কথাটি জানাব যে আজ,

পেছনে-সম্মুখে পথে-ঘাটে শত বাধা পার হয়ে

যাব নতুন জন্মের আঁচ নিতে নিতে...

গারো (আচিক) ভাষা

ব্যঞ্জন মৃ

পাখির সত্য বয়ান

অনুবাদ: পরাগ রিছিল

পাখির সত্য বয়ান

কারা খেলে সব কাবার

ছাগল যেমন সব সাবাড়

সে ধ্রুবসত্য বলছিল পীরেন স্লান!

এক টানে ডেকে যায়,

গিম্বিল-বলদুরেং নানান গাছ

মৌচাক, গাছেই বাসা বাঁধো

চলেশ-কথা অধিকারে হও জাগ্রত।

বুধু আদা বুধু,

কী সুন্দর প্রকৃতির ঢল

ভালোবাসি পথ চলতে নিটোল

কেন চলতে পারি না, উৎপল?

হে সত্যদ্রষ্টা,

নানা প্রজাতির পাখির বয়ান

পেরিয়ে যায় নতুন স্থান

নেত্তা খামাল তেজোদীপ্ত

ধরেছে নতুন সুরের টান...

টীকা: পীরেন স্লান—ইকোপার্কবিরোধী আন্দোলনে মারা যান।

গিম্বিল-বলদুরেং—টাঙ্গাঈলের মধুপুর অঞ্চলের দুটি গাছ।

চলেশ-কথা—গারো অধিকার আন্দোলনের নেতা চলেশ রিছিলের বক্তব্য।

বুধু আদা বুধু—পাখিবিশেষ।