নারী ঘুষ দেন, কখনো কখনো নেন

রাজধানীতে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। পাশে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল l প্রথম আলো
রাজধানীতে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। পাশে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল l প্রথম আলো

নারী নির্যাতন মামলা থানায় করা থেকে শুনানি পর্যন্ত ৩০০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় নারীকে। শুনানির জন্য ঘুষের টাকা কার কাছ থেকে কার কাছে যায়, সে সম্পর্কেও নারীদের পরিষ্কার ধারণা নেই। তবে নারী শুধু সেবা পেতে ঘুষ দেন না, সেবা দিয়ে নারী ঘুষও নেন।
গাজীপুর ও জামালপুরের দুটি ইউনিয়নে নারীদের ওপর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে। এতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি, ব্যাংক, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন খাতে নারী কীভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন, দেখানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ধানমন্ডির টিআইবি কার্যালয়ে ‘নারী অভিজ্ঞতায় দুর্নীতি: বাংলাদেশের দুটি ইউনিয়নের চিত্র’ শিরোনামে গবেষণাটি উপস্থাপন করা হয়।
অনুষ্ঠানে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, নারী তাঁর অসহায়ত্বের জন্য দুর্নীতির শিকার হন। নারী যখন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হন, তখন তিনি দ্বিমাত্রিক-ত্রিমাত্রিক সমস্যার সম্মুখীন হন। কোনো কোনো সময় দুর্নীতি করার ক্ষেত্রে নারীকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা সহজ। নারী বলেই তিনি দুর্নীতি করবেন না, এমন ধারণাও ঠিক নয়।
গবেষণার আওতায় জানুয়ারি ২০১৩ থেকে ডিসেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে টিআইবির গবেষণা দল। এই দলে ছিলেন ফাতেমা আফরোজ, শরীফ আহমেদ চৌধুরী, শাম্মী শায়লা ইসলাম, দিপু রায় ও শাহজাদা এম আকরাম। দুর্নীতির সরাসরি শিকার হয়েছেন এমন ৬৬ নারী তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এতে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এনজিও, বিচারিক সেবা, ভূমি, ব্যাংক ইত্যাদি খাতভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পেতে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ভিজিডি-ভিজিএফ কার্ড পেতে, মাটি কাটার কাজ পেতে, নারী নির্যাতন মামলা করতে ও উপবৃত্তি পেতে নারীদের ঘুষ দিতে হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে কিংবা উন্নয়ন বরাদ্দ পেতে দুর্নীতির শিকার হতে হয় ইউপির নারী সদস্যদের।
এসব সেবা যখন নারী দিচ্ছেন, তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরাও দুর্নীতিতে জড়াচ্ছেন। যেমন হাসপাতালের ওষুধ বাইরে বিক্রি করা, কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সুস্থ মানুষকে রোগী হিসেবে দেখানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপবৃত্তির টাকা বিতরণে ও শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে বাধ্য করা। আবার কোনো কোনো নারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বন্ধেরও উদ্যোগ নিয়েছেন এমন প্রমাণ আছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, নারী মনে করে, প্রাতিষ্ঠানিক সেবার ক্ষেত্রে সেবাদাতা যদি চায়, তাহলে তা ঘুষ, নিজে থেকে দিলে তা ঘুষ নয়। বাবা-স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়া, উত্তরাধিকার সূত্রের জমির দখল না পাওয়া, আবার সেই জমি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজারদরের চেয়ে কম দামে ভাইদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হওয়া, ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঋণের টাকা ও স্বামীর টাকা আত্মসাৎ করা, যৌন হয়রানি বা নিপীড়নের বিনিময়ে সেবা পাওয়াকে নারী দুর্নীতি বলে গণ্য করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নারী পরিবার পরিকল্পনা সহকারী পদে চাকরির জন্য পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত এবং প্রাথমিক শিক্ষক নিবন্ধনের জন্য দুই লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে চেয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা বারবার বলছি, সেবা পেতে নিয়মবহির্ভূত অর্থের লেনদেন মানুষের সাধারণ জীবনযাপনের অংশ হয়ে যাচ্ছে। কারণ মানুষ দেখছে, যাঁরা দুর্নীতি করছেন তাঁদের শাস্তি হচ্ছে না, হলেও সেটা নামমাত্র এবং প্রতীকী। নারী সেবা পেতে দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন, নারী দুর্নীতির মাধ্যম হচ্ছেন, কখনো কখনো নিজেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন।’
গবেষণাতেই উঠে এসেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেবার বিনিময়ে নারীও দুর্নীতি করছেন। দুর্নীতির শিকার হয়েছেন এমন এক নারীকে উদ্ধৃত করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। ওই নারী বলছেন, ‘মেম্বারনি আমারে কয়, কার্ড আছে করবেন? চারটা কার্ড পাইছি, এহন একটাই আছে। নিলে নেন, না নিলে আরেকজনরে বেশি টাকায় দিয়া দিমু। আমি করমু কইলে কয় টাকা লাগব জিগাই। মেম্বারনি কয়, ২৭০০ টাকা দিতে হইব। ১০ হাজারের মতো পামু, তিন হাজার দিয়াও যদি ৭ হাজার পাই, তাই তো লাভ। কিন্তু বলে নাই যে সরকার ফ্রি দিতেছে।’
টিআইবি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রাখার নিশ্চয়তাসহ অভিযোগ করার নারীবান্ধব ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করেছে টিআইবি।

নারী নির্যাতনের মামলা পরিচালনায় ঘুষ
থানায় মামলা
২০০০–৫০০০ ৳
অনুসন্ধানে চা–নাশতা
৩০০–৬০০ ৳
মামলা আদালতে ওঠানো
৫০০০ ৳
আসামি ধরতে পুলিশের গাড়ির তেল খরচ ও যাতায়াত
২০,০০০–৪০,০০০ ৳
শুনানি
১০,০০০–১৫,০০০ ৳