নাসিরনগরে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল কে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ এনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ১৫টি মন্দির ও শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার তিন বছর পূর্ণ হলো গতকাল বুধবার। এসব ঘটনায় আটটি মামলা হয়। ঘটনার ১৩ মাস পর একটি মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। বাকি সাতটি মামলার অভিযোগপত্র আজও দেওয়া হয়নি। 

রসরাজ দাসের ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ছবিকে কেন্দ্র করে ওই হামলা চালানো হয়। কিন্তু রসরাজ ওই পোস্ট দেননি। তাঁর ফেসবুক, মুঠোফোন ও মেমোরি কার্ডের ফরেনসিক প্রতিবেদনে তাঁর আইডি থেকে ওই পোস্ট দেওয়ার কোনো আলামত পায়নি পিবিআই। তাহলে কে দিয়েছিলেন এই পোস্ট? তিন বছরেও এর কোনো উত্তর মেলেনি।

রসরাজ দাস উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর ফেসবুকের পোস্টের জেরে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর সকালে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’–এর উপজেলা শাখার নেতারা নাসিরনগর ডিগ্রি কলেজ মোড়ে বিক্ষোভের ডাক দেন। অন্যদিকে ‘খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’–এর নেতারা নাসিরনগর খেলার মাঠে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেন। পৃথক এই সমাবেশ চলাকালে উপজেলা সদরে ১৫টি হিন্দু মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

 পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থতার দায়ে প্রথমে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদের এবং পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মোয়াজ্জাম আহমদকে প্রত্যাহার করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলা সদরের দত্তপাড়ার দত্তবাড়ির পারিবারিক মন্দির হামলার ঘটনায় কাজল জ্যোতি দত্ত বাদী হয়ে একটি, কাশীপাড়ার গৌরমন্দিরে হামলার ঘটনায় নির্মল চৌধুরী বাদী হয়ে একটি, চেঙ্গাপাড়ার ছোট্ট লাল দাসের বাড়িতে আগুনের ঘটনায় একটি, পশ্চিমপাড়া ও বণিকপাড়া ‍দুটি বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় এসআই সাধন কান্তি দাস চৌধুরী দুটি মামলা, বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন কুমার দেব বাদী হয়ে একটি, রসরাজ দাসের বাড়িতে হামলার ঘটনায় তাঁর ভাই দয়াময় দাস বাদী হয়ে একটিসহ মোট সাতটি মামলা দায়ের করেন। তা ছাড়া ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ এনে রসরাজের নামে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ধারায় মামলা করে পুলিশ। এই আট মামলায় প্রায় তিন হাজার লোককে আসামি করা হয়। রসরাজের মামলাটির তদন্ত চলছে। রসরাজ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে জামিনে মুক্তি পান।

উপজেলা সদরের মহাকালপাড়া গৌরমন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় মন্দিরের পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্মল চৌধুরী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১০০০-১২০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এজাহারে অভিযোগ করা হয়, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত, বাংলাদেশি ইসলামি ফ্রন্ট ও গাউছিয়া যুব সংগঠন এসব হামলার সঙ্গে জড়িত। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর গৌরমন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২২৮ জনের নাম উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান, একাধিক আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতার নাম রয়েছে। ওই অভিযোগপত্রে ২২৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়। 

>নাসিরনগরে হামলার ৩ বছর
আট মামলার মাত্র একটির অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ
অন্য সাতটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি


এদিকে রসরাজ দাসের মামলার আইনজীবী নাসির মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ১৯ ডিসেম্বর রসরাজ দাসের নামে মামলায় পুলিশের প্রতিবেদন দাখিলের কথা রয়েছে। তবে এ মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রসরাজের ফেসবুক, মুঠোফোন ও মেমোরি কার্ড–সংক্রান্ত ফরেনসিক প্রতিবেদন দিয়েছে। আপত্তিকর ওই পোস্ট রসরাজের ফেসবুক, মুঠোফোন ও মেমোরি কার্ড থেকে দেওয়ার কোনো আলামত পায়নি পিবিআই। তিনি বলেন, রসরাজ দাসের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ধারায় করা মামলায় আরও তিন বছর আগেই পুলিশ দুজন সাক্ষীর ১৬১ ধারায় জবানবন্দি নথিভুক্ত করে এবং আদালত একজন সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নথিভুক্ত করেন। এত দিন পার হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

দত্তবাড়ি ও নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামে রসরাজের বাড়িতে হামলার ঘটনার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন বলেন, দুটি মামলারই তদন্ত চলছে। দত্তবাড়ির মামলার আসামি অনেক। ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছেন। আর হরিপুরে রসরাজের বাড়িতে হামলায়ও ১০০ থেকে ১৫০ অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছেন। তাই সময় লাগছে। 

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। ঘটনার ভিডিও ফুটেজসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে তদন্ত করা হচ্ছে। অজ্ঞাতনামা অসংখ্য আসামি। তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব অপরাধী আইনের আওতায় আসুক।’