নাসিরনগরে হামলায় আ. লীগ, বিএনপি, জনপ্রতিনিধি - সবাই জড়িত!

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যে সমাবেশ থেকে মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়, সেখানে লোকজন নেওয়ার জন্য ট্রাক ও ট্রাক্টর ভাড়া করেছিলেন স্থানীয় হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান, তাঁর ভাই ও সমর্থকেরা। হামলায় জনপ্রতিনিধি ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা নানাভাবে জড়িত।

হামলার ঘটনায় আদালতে এ পর্যন্ত চারজন সাক্ষী ও দুজন আসামির জবানবন্দিতে এ তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে আসামি জাহাঙ্গীর আলম আজ বৃহস্পতিবার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন বলেন, জাহাঙ্গীরের স্বীকারোক্তিতে চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান, তাঁর ভাই ও সমর্থকেরা ছাড়াও নাসিরনগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হান্নান মিয়া, হরিপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জামাল পাঠান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের লীগ সভাপতি ফারুক মিয়া, মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি কাপ্তান মিয়া ও হরিপুর ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হাজি বিল্লালসহ বেশ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে।

মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) ইশতিয়াক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীর বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম সুলতান সোহাগ উদ্দিনের আদালতে জবানবন্দি দেন।

জাহাঙ্গীর নাসিরনগর উপজেলার হরিণবেড় বাজারে আল আমিন সাইবার পয়েন্ট অ্যান্ড স্টুডিও নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। গত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান আতিকুর রহমানের পক্ষে তিনি কাজ করেছেন।

জাহাঙ্গীরের জবানবন্দির বরাত দিয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, ২৯ অক্টোবর সকালে হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় বাজার থেকে সংকরাদহ গ্রামের জুয়েল মিয়া নামের এক যুবকের কাছ থেকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটি নিজের মোবাইলে নেন জাহাঙ্গীর। ছবিটি কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রিন্ট করে ওই দিন রাতেই ৩০-৪০ টির মতো লিফলেট তৈরি করে বিলি করেন। হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক মিয়া, হাজি বিল্লাল ও কাপ্তান মিয়া রসরাজকে ধরে নিয়ে আসার জন্য জাহাঙ্গীরকে নির্দেশ দেন। জাহাঙ্গীর গ্রামের শামীম রেজা, গিয়াস উদ্দিন ও রিপন মিয়া নামের কয়েকজন যুবক রসরাজকে দুপুর ১২টার দিকে ধরে ফারুক মিয়া ও হাজি বিল্লাল মিয়ার কাছে সোপর্দ করেন। রসরাজের বিরুদ্ধে মামলা করতে থানায়ও যান জাহাঙ্গীর। সকালে রসরাজকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এর আগে ২৯ তারিখ সকালে হরিণবেড় বাজারে রসরাজের ফেসবুকের পোস্টটি নিয়ে স্থানীয় খালেদ মোবারক, ফারুক মিয়া, নয়ন মিয়া, ইউপি সদস্য প্রফুল্ল চন্দ্র দাস রসরাজের গ্রামের পাশের বাড়ির অনুকূল চন্দ্র দাসের ছেলে আশুতোষ চন্দ্র দাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন। সে সময় আশুতোষ বলেছিলেন, ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় কে বা কারা রসরাজের ফেসবুক আইডি থেকে এই পোস্ট করেছে। পরদিন বিদেশ থেকে একজন লোক বিষয়টি আশুতোষকে জানায়। পরে আশুতোষ রসরাজের ফেসবুক থেকে ক্ষমা প্রার্থনামূলক ওই পোস্ট দেয়। রসরাজের ফেসবুক আইডি ও পাসওয়ার্ড আশুতোষ জানত বলে তাঁদের জানান। ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় হরিপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জালাল পাঠান ফেসবুকের পোস্টটি ১০ কপি জাহাঙ্গীরের দোকান থেকে ফটোকপি করেন। আরেকজন লোক পোস্টটির রঙিন কপি নিতে চাইলে কম্পিউটার থেকে দুটি কপি করে দেন জাহাঙ্গীর। রাতে নাসিরনগর সদরে সমাবেশ প্রসঙ্গে স্থানীয় আলিয়া মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি কাপ্তান মিয়া হরিণবেড় বাজারে মাইকিং করেন। মাদ্রাসার মাইক দিয়েও মাইকিং করা হয়। রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত হরিণবেড় বাজারে হাজি বিল্লাল মিয়ার অফিসে একটি সভা হয়। সেখানে সমাবেশ সম্পর্কে আলোচনা হয়। কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান বাজারে আসেন। তখন হাজি বিল্লাল সব ঘটনা তাঁকে খুলে বলেন। ৩০ অক্টোবর হরিণবেড় বাজারে প্রচুর লোকজন জমায়েত হয়। সে সময় হাজি বিল্লাল মুঠোফোনে ট্রাকের ব্যবস্থা করছিলেন। সকালে বাজারের সমাবেশে বক্তব্যও দিয়েছিলেন হাজি বিল্লাল। একই দিকে ফারুকের নেতৃত্বে বাজারে একটি মিছিল হয়। সকালে চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান কিছু ট্রাকের ব্যবস্থা করার জন্য জাহাঙ্গীরকে নির্দেশ দেন। জাহাঙ্গীর, চেয়ারম্যানের বড় ভাই দেওয়ান রুবেল ও সুজন পাঠান গিয়ে সাতবর্গ বাজারের বাসস্ট্যান্ড থেকে পাঁচটি ট্রাক ভাড়া করে হরিণবেড় বাজারে নিয়ে যান। হরিণবেড় বাজারে হাজি বিল্লাল মিয়া ও কাপ্তান মিয়া চার-পাঁচটি ট্রাকের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তারপর বিল্লাল ও জাহাঙ্গীর মাইকে ডেকে লোকজনকে ট্রাকে উঠতে আহ্বান জানান। দুপুর ১২টার দিকে ট্রাকগুলো নাসিরনগর সদরের উদ্দেশে রওনা হয়। যাওয়ার পথে নরহা, বেলুয়া ও নুরপুর গ্রাম থেকে জামাল মিয়া, হান্নান মিয়া ও গোলাপ মিয়ার নেতৃত্বে কিছু লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে ট্রাকে ওঠেন। নাসিরনগর সদরে পৌঁছানোর পর লোকজন ট্রাক থেকে নেমে নাসিরনগর কলেজ মোড় ও স্থানীয় আশুতোষ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠের সমাবেশে যোগ দেন। সমাবেশ চলাকালীন সমাবেশ থেকে অধিকাংশ নাবালক বয়সের ছেলেরা মন্দির ও হিন্দুদের বাড়ি ভাঙচুর করে। জাহাঙ্গীর মোটরসাইকেলে করে সমাবেশে যোগ দেন বলে স্বীকার করেন। তবে কোনো ধরনের ভাঙচুরে অংশ নেননি বলে দাবি করেন।

প্রসঙ্গত, ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গত ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। নাসিরনগরের ঘটনায় এ পর্যন্ত আট মামলায় ১০২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।