স্বাস্থ্যখাতে অগ্রযাত্রার ৫০ : পর্ব—৪১
নিঃশব্দে কাজ করছে সাহিক
সাহিক তিন দশকের বেশি সময় ধরে চিকিৎসার মাধ্যমে শ্রবণ সমস্যা দূর করছে। শিশুদের শুনতে ও বলতে শেখাচ্ছে।
অনেকটা নিঃশব্দে বিশেষায়িত চিকিৎসা ও শিক্ষাসেবা দিচ্ছে সোসাইটি ফর অ্যাসিস্ট্যান্স টু হিয়ারিং ইম্পেয়ার্ড চিলড্রেন বা সাহিক। সাহিক নামেই এর পরিচিতি বেশি। কানের জটিল সমস্যা, শ্রবণপ্রতিবন্ধী বা একই সঙ্গে শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসা ও শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সাহিক।
রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশন (সিএমই) ভবনের মাঝে সাহিকের ছোট একটি ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসটি পরিচ্ছন্ন, শান্ত এবং সুশৃঙ্খল। ক্যাম্পাসের মধ্যে আছে একটি হাসপাতাল, একটি স্কুল, আছে গেস্টহাউস। ছোট চত্বরে আছে ফুলবাগান।
শ্রবণ সমস্যা নির্ণয় ও চিকিৎসার অনেক কিছুই দেশে শুরু করেছিল সাহিক। জন্ম থেকে শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী শিশুরা যে শ্রবণ ও বাক্শক্তি ফিরে পেতে পারে, তা দেখিয়েছে সাহিক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) নাক কান গলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম নুরুল আমিনের উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। দেশের প্রতিথযশা বেশ কয়েকজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ এখানে কাজ করেছেন। সাহিকের হাসপাতালে অনেক জটিল ও কঠিন অস্ত্রোপচার হয়েছে, যা আগে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে হয়নি। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে এই হাসপাতালে আট বছর বয়সী একটি মেয়েশিশুর কানের ভেতরে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট বসানো হয়। এটি ছিল ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহারের দেশের প্রথম ঘটনা।
কাগজপত্র বলছে, কম বয়সের বধিরতা বা শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা নিরূপণ, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ এবং শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা নিবারণ করা সাহিকের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে তিন দশকের বেশি সময় ধরে চিকিৎসার পাশাপাশি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পুনর্বাসন সেবা দিচ্ছে সাহিক। তবে নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা, পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতিসহ বেশ কিছু কারণে প্রতিষ্ঠানটির উজ্জ্বলতা অনেকটা ম্লান হতে বসেছে।
নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনিলাল আইচ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রবণ সমস্যা নির্ণয় ও চিকিৎসার অনেক কিছুই দেশে শুরু করেছিল সাহিক। জন্ম থেকে শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী শিশুরা যে শ্রবণ ও বাক্শক্তি ফিরে পেতে পারে, তা দেখিয়েছে সাহিক।’
শোনা ও বলার হাসপাতাল
সাহিকের হাসপাতাল দেশের অন্যতম সেরা শ্রুতিনির্ণয় কেন্দ্র। সব বয়সী ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এখানে কানের পরীক্ষা করাতে পারে। দরিদ্ররা এখানে কম মূল্যে বা বিনা মূল্যে চিকিৎসা পেতে পারে। চিকিৎসার মধ্যে আছে ওষুধ দেওয়া, অস্ত্রোপচার ও শ্রুতিযন্ত্র স্থাপনে সহায়তা।
হাসপাতালে শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধীতার মোট ২২ ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। এখানে কানে শোনার যন্ত্র বা হিয়ারিং এইড বিক্রি হয় না, তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিয়ারিং এইড কানে জুতসইভাবে লাগানোর জন্য ইয়ার মোল্ড বা কানের ছাঁচ তৈরি করা হয়। সঠিক যন্ত্র কেনা বা কেউ যেন প্রতারণার শিকার না হয়, সে ব্যাপারে এই প্রতিষ্ঠান সহায়তা করে।
হাসপাতালের বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে ৩০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। এ ক্ষেত্রে শিশুরা অগ্রাধিকার পায়। বহির্বিভাগে পরামর্শ দেওয়া ছাড়াও ১২ থেকে ১৫ জন রোগীর পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হয়।
প্রতিষ্ঠানের দোতলায় শিশুদের বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য রয়েছে ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর হিয়ারিং অ্যান্ড স্পিচ ফর চিলড্রেন’। এই কেন্দ্রে আধুনিক শল্যচিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এই কেন্দ্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই সময় রোগীরা যেমন চিকিৎসা পায়, পাশাপাশি এদেশীয় চিকিৎসকেরা হাতে–কলমে চিকিৎসাপদ্ধতি শেখার সুযোগ পান। এর মাধ্যমে টেকনোলজি ট্রান্সফার বা প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ তৈরি হয়।
হাসপাতালের আছে স্পিচ থেরাপি বিভাগ। এই বিভাগে কথা বলার সমস্যা দূর করা বা ভাঙা কণ্ঠস্বর ঠিক করার চিকিৎসা দেওয়া হয়। এই চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিতে নিয়মিতভাবে জার্মানি ও যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষজ্ঞরা এই প্রতিষ্ঠানে আসেন। তাঁরা চিকিৎসার পাশাপাশি এ দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেন। এ পর্যন্ত ১৫৭ জন এই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে সাহিকের একটি উপকেন্দ্র আছে। এ ছাড়া সাহিকের আছে একটি ‘ভ্রাম্যমাণ গ্রামীণ কর্ণশিবির’।
নতুন জীবনের স্কুল
অনেক শিশু জন্ম থেকে কানে শুনতে পায় না। কানে শোনে না, এমন শিশুদের কথা বলাতেও সমস্যা হয়। এসব শিশুর স্বাভাবিক শ্রবণ ও বাক্শক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মহাখালীর ক্যাম্পাসে আছে একটি সমন্বিত প্রাক্–বিদ্যালয়। এর নাম রোজী ফ্লাওয়ার বধির শিশুদের সমন্বিত প্রাক্বিদ্যালয়। সাহিক প্রতিষ্ঠায় ও পরিচালনার শুরুতে আর্থিকসহ নানা ধরনের সহায়তা দিয়েছিল জার্মানির প্রতিষ্ঠান আন্ধেরি–হিল্ফে ও তার তৎকালীন সভাপতি মিস ক্যাথে রোজলাইন গোলম্যান। বিদ্যালয়টির নাম মূলত রোজলাইন গোলম্যানের নাম অনুসারেই হয়েছে।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুনমুন ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, তিন থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের এখানে ভর্তি করানো হয়। শ্রবণপ্রতিবন্ধী, কথা বলতে পারে না, অটিস্টিক এবং ডাউন সিন্ড্রমের শিশুদের এখানে ভর্তি করানো হয়।
বর্তমানে এখানে প্রায় ৩০০ শিশু ভর্তি আছে। এর মধ্যে ২৫৫ জন প্রতিবন্ধী শিশু, বাকিরা স্বাভাবিক শ্রুতিসম্পন্ন শিশু। ১৪টি শ্রেণিকক্ষে এদের সকাল–বিকেল দুই পালায় ক্লাস হয়। স্কুলে ভর্তির আগে শিশুদের শ্রবণপ্রতিবন্ধিতার মাত্রা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হয় এবং প্রয়োজনীয় হিয়ারিং এইড সংযোজন করা হয়।
১৯৯১ সাল থেকে সাহিকে কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ কনসালট্যান্ট এম এ সামাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে বিরল কিছু অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাঁর ভিত্তিতে তৈরি গবেষণা প্রবন্ধ বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম বাড়িয়েছে। দেশে শ্রবণপ্রতিবন্ধিতার প্রথম জরিপও করেছিল এই প্রতিষ্ঠান। দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠানকে গবেষণায় সহায়তা দেয় সাহিক।