নিখোঁজ যুবক, হত্যার ছবি আইএসের সাইটে

  • নিখোঁজ যুবক ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের সোহেল রানা

  • তিনি ছিলেন মাইজভান্ডারীর অনুসারী

  • গাজীপুরের বরমীবাজারে তাবিজ-কবচ বিক্রি করতেন।

সোহেল রানা

বিশ্বব্যাপী জঙ্গিগোষ্ঠীর অনলাইন তৎ​পরতা পর্যবেক্ষণকারী সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ গত ১৬ আগস্ট দুটি ছবি প্রকাশ করে। ছবির শিরোনামে তারা লিখেছিল, ‘বাংলাদেশের রাজধানীর উত্তরে জাদুবিদ্যার চর্চাকারীকে আইএসের হত্যার প্রমাণাদি’। কিন্তু ওই ব্যক্তির নাম-পরিচয় কিছুই সেখানে উল্লেখ ছিল না।

আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস তাদের অনলাইন চ্যানেল বা সাইটে ওই ছবি ​ও দাবির কথা প্রকাশ করে, যা পরে সাইট ইন্টেলিজেন্স তাদের সাইটে দেয়। যদিও এ ধরনের কোনো হত্যার ঘটনা দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না।

তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ছবির ওই ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁর নাম সোহেল রানা (৩৮)। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের শিলাসী গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেমের বড় ছেলে তিনি। এক মাসের বেশি সময় ধরে তিনি নিখোঁজ বলে জানিয়েছে পরিবার।

আইএসের প্রকাশিত যে দুটি ছবি ১৬ আগস্ট সাইট ইন্টেলিজেন্স প্রকাশ করেছে, তার একটিতে গেরুয়া রঙের গেঞ্জি পরে সোহেল দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মাথা ন্যাড়া, গলায় দুটি বড় পুঁতির মালা ও পরিচয়পত্র ধরনের কিছু একটা ঝুলছে। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ন্যাড়া মাথার গেরুয়া পোশাক পরা এক ব্যক্তি জঙ্গলে পড়ে রয়েছেন। তাঁর হাত-পা সাদা রশি দিয়ে বাঁধা। মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে গলায়ও সাদা রশি প্যাঁচানো। তবে ছবিটিতে তাঁর চেহারা স্পষ্ট নয়।

সাইট ইন্টেলিজেন্সের শিরোনামে বলা হয়েছিল, রাজধানীর উত্তরে আইএস জঙ্গিরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঢাকার উত্তর পাশে রয়েছে গাজীপুর। গেরুয়া রঙের গেঞ্জি পরা সোহেলের ছবি নিয়ে সেখানে অনুসন্ধান চালায় প্রথম আলো। গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমীবাজার এলাকার লোকজন ছবি দেখে সোহেলকে শনাক্ত করেন। তাঁরা জানান, সোহেল দুই বছর ধরে বরমীবাজার এলাকায় থাকছিলেন। বাজারে ঘুরেফিরে আংটি, চুড়ি, তাবিজ-কবচ বিক্রি করতেন। তাঁর পোশাক ছিল বিচিত্র। বাজারের একটি সেলুনে তিনি রাত যাপন করতেন।

৭ সেপ্টেম্বর বরমীবাজারে গেলে ওই সেলুনমালিক নিরু প্রথম আলোকে বলেন, সোহেলকে তাঁরা সুজন বলে ডাকতেন। বাজারের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করতেন তিনি। রাত হলে বেশির ভাগ সময় তাঁর সেলুনে এসে ঘুমাতেন। তবে গত কোরবানির ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে তিনি আর আসেন না। তাঁর বাড়ি গফরগাঁওয়ের শিলাসী গ্রামে।

নিরুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী শিলাসী গ্রামে খোঁজ নিয়ে সোহেলের পরিবারের খোঁজ মেলে। তাঁর বাবা আবুল কাশেমের গফরগাঁও শহরে ঘড়ির দোকান ছিল। সোহেলও সেখানে বসতেন একসময়। আবুল কাশেম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিকভাবে তাঁরা মাইজভান্ডারীর অনুসারী। বছর পনেরো আগে সোহেলও মাইজভান্ডারীর মুরিদ হন, নামের সঙ্গে মাইজভান্ডারী যোগ করেন। এরপর থেকে সোহেল মাজারে মাজারে থাকতেন। সর্বশেষ গাজীপুরের বরমীবাজার এলাকায় থাকছিলেন। সেখানে তাবিজ-কবচ বিক্রি করতেন। এক-দুই মাস পরপর বাড়িতে যেতেন।

কাশেম বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে বাড়িতে এসে মাসখানেক ছিলেন সোহেল। গত ঈদুল আজহার এক সপ্তাহ আগে আবার বরমীবাজারে ফিরে যান। ছেলের সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ কথা হয়েছিল গত ৩১ জুলাই। জানিয়েছিলেন পরদিন (ঈদুল আজহার দিন) তিনি বাড়িতে আসবেন। ঈদ গেল, কিন্তু সোহেল বাড়িতে আসেননি। তাঁর ফোনও বন্ধ। ছেলের কী হয়েছে, কোথায় আছেন, সেটা কাশেমের জানা নেই। এই প্রতিবেদক যখন সোহেলের খোঁজখবর করছিলেন, তখন কাশেম বারবার জানতে চাচ্ছিলেন তাঁর ছেলের কী হয়েছে।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, সাইট ইন্টেলিজেন্সের প্রকাশিত ছবিটি ধরে তাঁরা তদন্ত করছেন। এরই মধ্যে ওই ব্যক্তির একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তাঁরা পেয়েছেন। সেটি যাচাই-বাছাই করছেন। তিনি বলেন, ঢাকার পল্টন ও নওগাঁর সাপাহারে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় সিলেট থেকে নব্য জেএমবির যে পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাঁদের কাছ থেকে এ বিষয়ে তথ্য পেয়েছেন। প্রকাশিত ছবির ব্যক্তিটিকে হত্যা করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে সিটিটিসি এখনও নিশ্চিত নয়। কারণ, তাঁর লাশ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

সাইট ইন্টেলিজেন্সের প্রকাশিত ছবিটি ধরে তাঁরা তদন্ত করছেন। এরই মধ্যে ওই ব্যক্তির একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তাঁরা পেয়েছেন। সেটি যাচাই-বাছাই করছেন
সাইফুল ইসলাম, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপকমিশনার

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএসের তৎপরতার কথা বরাবরই নাকচ করে আসছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতিপূর্বে আইএসের নামে যেসব হামলা ও হত্যার ঘটনার দায় স্বীকারের খবর বেরিয়েছে, সেগুলোতে দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবি জড়িত বলে সিটিটিসি বলে আসছে।

২০১৬ সালে ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হামলায়ও আইএসপন্থী এই জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত ছিল। এর চার বছর পর আবার আইএস ​কাউকে হত্যার দাবি করল। তার আগে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশকে লক্ষ্য করে জঙ্গিরা কয়েকটা বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। সেসব ঘটনায়ও আইএসের নামে দায় স্বীকারের বিবৃতি এসেছিল। এই অবস্থায় জঙ্গিরা নতুন করে চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে কি না, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আইএসের হয়ে যারা চেষ্টা চালাচ্ছে, তাঁরা তাদের লক্ষ্য থেকে সরেনি। তারা হয়তো বড় কোনো টার্গেটে যাচ্ছে না। তার মানে এই নয় যে তাদের চেষ্টা বন্ধ হয়ে গেছে। নিজেদের সক্রিয় দেখাতে এবং আরও অনেককে উদ্বুদ্ধ করতে তারা এই কাজ করছে।