নিখোঁজের ১৪ বছর পর ফিরে আসা তরুণের জবানবন্দি

নিখোঁজের ১৪ বছর ৪ মাস ৭ দিন পর নিজেই গ্রামে ফিরে আসা সেই ‘অপহৃত’ তরুণ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, কেউ তাঁকে অপহরণ করেননি।

শুক্রবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল মোহসীনের আদালতে পালিয়ে থাকার বিষয় জানিয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দেন রুবেল (২১)। আদালত জবানবন্দি রেকর্ড শেষে তাঁকে নিজ জিম্মায় মুক্তি দেন।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে জানান, ১৪ বছর আত্মগোপনে থাকা রুবেলকে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার পুলিশ শুক্রবার বিকেলে আদালতে প্রেরণ করে। আদালতে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। জবানবন্দি শেষে আদালত তাঁকে নিজ জিম্মায় মুক্তি দেন। তিনি বলেন, আদালত খণ্ড নথি মূল নথির সঙ্গে যুক্ত করার আদেশ দিয়েছেন। খণ্ড নথি মূল নথির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর আদালত আদেশ দেবেন।

২০০৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার আলীরটেক ইউনিয়নের কুড়েরপাড় এলাকার ৭ বছর বয়সী শিশু রুবেলকে অপহরণ করা হয়েছে অভিযোগ এনে তাঁর মা রহিমা বেগম বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ আদালতে অপহরণ মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় বাদী ২ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৯ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিদের মধ্যে ৬ জন বিভিন্ন মেয়াদে জেলহাজতে ছিলেন।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নিখোঁজ রুবেল এলাকায় ফিরে এলে খবর পেয়ে অপহরণ মামলার আসামি হয়ে হয়রানির শিকার দুই মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যরা রুবেলকে আটক করেন। পরে তাঁকে রাত ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশের কাছে সোর্পদ করা হয়।

এ বিষয়ে নারায়ণগগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ্ জামান প্রথম আলোকে জানান, রুবেল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানান, রুবেলকে কেউ অপহরণ করেননি। তাঁরা গরু পালতেন। তাঁর মা তাঁকে গরুর দুধ দোহনের ও বাছুর যাতে গরুর দুধ খেয়ে ফেলতে না পারে, তার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বাছুর তাঁদের গরুর দুধ খেয়ে ফেলে। দুধ খেয়ে ফেলার কারণে মা তাঁকে মারবেন—এই ভয়ে তিনি সাত বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। পরে তিনি ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গত ১৪ বছর কাজ করে কাটান। বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি এলাকায় ফিরে এলে তাঁর মায়ের অপহরণ মামলার আসামিরা তাঁকে আটক করে পুলিশে সোর্পদ করেন।

ফিরে আসা রুবেল বলেন, ‘দুইটা গরু পালতাম। গরুর জন্য ঘাস না কাটলে মা মারতেন। আবার ঘরে গিয়ে খাওন পাইতাম না। মার অত্যাচারে সাত বছর বয়সে ঘর থেইকা বাইর হইয়া গেছিলাম। এত বছর ঢাকার মগবাজার, হাতিরঝিলে। ওইখানে রঙের কাজ করতাম। ফাস্ট ফুডের দোকানে ও ইস্টার্ন প্লাজায় কাজ করছি। পরে এখানেই একটা মেয়েরে বিয়া করছি। গত বছর আমাগো এক আত্মীয়র সাথে দেখা হইছে। তার মাধ্যমে মার সঙ্গে কথা হয়। মারে কইলাম, বাড়ি আসি। তখন মায় কইল, বাড়িতে আসলে গ্রামের মানুষ তরে মাইরা ফেলব। আমি তাগো নামে মামলা করছি। তাই ভয়ে আসি নাই। আজ কাউরে কিছু নাই কইয়া গ্রামে আসছি, কিন্তু গ্রামের মানুষ আমারে চিনতে পেরে আটকে পুলিশের কাছে নিয়ে গেছে।’

গ্রেপ্তার হয়ে আড়াই মাস কারাগারে থাকা মুক্তিযোদ্ধা জুলহাস উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘রুবেল নামের এই তরুণকে আমি কখনো দেখিনি। তাঁকে আজ প্রথম দেখলাম। কিন্তু তাঁকে অপহরণের অভিযোগে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে কারাগারে ছিলাম আড়াই মাস। আমার মতো আরও পাঁচজন দুই থেকে চার মাস পর্যন্ত জেল খেটেছেন। এরপর আদালত থেকে জামিনে বের হয়েছি আমরা। পরে তো মামলাই শেষ হলো। আজ শুনলাম, রুবেল ফিরে এসেছে গ্রামে। পরে গ্রামবাসী ও আমরা তাকে থানায় নিয়ে এসেছি।’

গ্রেপ্তার এবং হয়রানির শিকার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, তাঁরা ওই শিশুকে চিনতেন না। তাঁরা কেউ ওই শিশুকে দেখেননি। কিন্তু তাঁদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। এতে জেল খাটানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, রুবেলের মা রহিমার মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান। তিনি এ মামলা তদন্ত করে ২০০৮ সালের ৩০ জুলাই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তবে মামলার বাদী রহিমা আদালতে পুলিশের তদন্তে নারাজি দেন। পরে মামলার তদন্ত পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ সংস্থাও কয়েক মাস তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় আদালতে। তবে রহিমা তাতেও নারাজি দেন। পরে দায়িত্ব পান র‍্যাব। এ সংস্থা মামলায় অভিযুক্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁদের রিমান্ডে নেওয়া হয়। তবে তারা তদন্ত শেষ করতে না পারায় মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের এসআই আসাদুজ্জামান ফরাজী তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই দিন মামলাটি নিষ্পত্তি করেন আদালত।