নিবন্ধন ছাড়াই চলাচল, নেই চালকের প্রশিক্ষণ

নিবন্ধন আছে মাত্র ৫৬৯টি স্পিডবোটের। তবে বিভিন্ন নৌপথে চলে দুই হাজারের বেশি স্পিডবোট।

বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌপথে চলাচল করে এসব স্পিডবোট। সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাটে।
ফাইল ছবি

দেশের বিভিন্ন নৌপথে চলাচলের জন্য নিবন্ধন আছে ৫৬৯টি স্পিডবোটের। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, যাত্রী পরিবহন করে দুই হাজারের বেশি স্পিডবোট। এসব নৌযান চালান প্রশিক্ষণবিহীন চালকেরা। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী সূর্য ডোবার পর দ্রুতগামী এই নৌযানের চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞাও মানা হয় না।

কোনো দুর্ঘটনার পর এসব অনিয়ম আলোচনায় আসে। তবে ঘটনার কিছুদিন যেতে না যেতে আলোচনা মিইয়ে যায়। অদক্ষ চালক দিয়ে নিবন্ধনবিহীন স্পিডবোট চলাচল বন্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।

গত ৩ মে মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটের সামনে নদীতে নোঙর করে রাখা একটি বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের ধাক্কায় নিহত হন ২৬ জন। নৌযান দুটির নিবন্ধন ও ফিটনেস ছিল না। ছিল না চালকদের লাইসেন্সও। উত্তাল পদ্মায় অদক্ষ চালক দিয়ে স্পিডবোট চালানোয় এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে তদন্তে উঠে আসে।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরে নিবন্ধিত মোট স্পিডবোটের সংখ্যা ৫৬৯। তবে বিভিন্ন স্থানীয় সূত্র ও নৌপথ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের বিভিন্ন নৌপথে দুই হাজারের বেশি স্পিডবোট চলাচল করে। দ্রুততম সময়ে বেশি দূরত্বের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য হাওর ও উপকূলীয় এলাকাসহ বিভিন্ন নৌপথে স্পিডবোটের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে।

বিভিন্ন নৌপথে চলাচলকারী স্পিডবোটের চালকদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এমনকি চালকদের বড় একটি অংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক।

সম্প্রতি এই নৌপথে চলাচলকারী বেশ কিছু চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

এত দিনেও কেন চালকদের সনদ নিতে বাধ্য করা গেল না, এমন প্রশ্নে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. মনজুরুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৬ সালের নৌচলাচল অধ্যাদেশে অনুযায়ী স্পিডবোটের চালকদের সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক। এত দিন তাঁরা আসেননি বলেই সনদ দেওয়া হয়নি।

বাংলাবাজারের দুর্ঘটনার পর চালকদের সনদ এবং মালিকদের স্পিডবোটের নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদের আওতায় আনতে নৌপরিবহন অধিদপ্তর উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান মনজুরুল কবীর। স্পিডবোট চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষসহ (বিআইডব্লিউটিএ) সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করেন তিনি।

স্পিডবোটচালকদের লাইসেন্স দেওয়া প্রসঙ্গে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাবাজারে দুর্ঘটনার

পর সারা দেশের চালকদের সনদ দিতে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছে।

অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাবাজারের দুর্ঘটনার পর মাওয়ার ১৩৬টি স্পিডবোটকে নিবন্ধন ও সার্ভের আওতায় আনে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। এক দিনের কর্মশালার পর ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে মাওয়া ও আরিচায় ১৯৮ জনকে সনদ দেওয়া হয়। তবে তিন থেকে চার বছর তাঁরা স্পিডবোট চালিয়েছেন, মালিকের কাছ থেকে এমন প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হয়েছে তাঁদের। বরিশালের ১১০ জন চালকের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।

চালকদের সনদ নিতে আগ্রহ না দেখানোর কারণ হিসেবে একটি নিয়মের কথা উল্লেখ করেন শিমুলিয়া ঘাটের ইজারাদার সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, কোনো চালক সনদ নিতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি নিয়ে মাদক পরীক্ষা করাতে হয়। এ কাজ করতে গিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়। মূলত এ কারণেই চালকেরা সনদ নিতে আগ্রহী হন না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জাহাজচালকদের সংগঠন কোস্টাল মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ওয়েজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, স্পিডবোটচালকদের জন্য দেশে এখন পৃথক কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। তাঁরা অভিজ্ঞ চালকের সঙ্গে থেকে স্পিডবোট চালানো শেখেন। চালকদের জন্য পৃথক কোর্স চালু করা যেতে পারে।

সম্প্রতি সন্ধ্যার পর বরিশালের ডিসি ঘাটে সরেজমিনে দেখা যায়, ভোলাগামী স্পিডবোটগুলো যাত্রীর অপেক্ষায়। ঘাটের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই নৌপথে অন্ধকারের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে স্পিডবোটগুলো। মুঠোফান বা টর্চের আলো জ্বেলে সামনে বা পেছনের স্পিডবোটের চালককে সংকেত দেন অন্য চালক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের একজন পরিদর্শক প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ নৌযান ও চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধান সমস্যা প্রয়োজনীয় নৌযান, লোকবলের অভাব। আর স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা স্পিডবোটের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে তাঁদের বিরুদ্ধে চাইলেও সব সময় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার, বরিশাল ও ভৈরব এবং প্রতিনিধি, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, নরসিংদী ও রাঙামাটি]