
সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকা দক্ষিণের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মোহাম্মদ সাঈদ খোকন প্রথম আলোর মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর পরামর্শক সম্পাদক কামাল আহমেদ
প্রথম আলো: প্রথমেই যেটা জানতে চাই সেটা হলো মেয়র হওয়াটা আপনার কাছে এত জরুরি কেন যে বাড়ি বিক্রি করে নির্বাচনে দাঁড়াতে হলো?
সাঈদ খোকন: ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি, যেটা ব্যবসার জন্য খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। আমার লিগ্যাল কাভারেজ ছিল এবং আমি সময় নিতে পারতাম। কিন্তু দেখলাম বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণা আসছে এবং মানুষের মধ্যেও নানা প্রশ্ন উঠছে। সে জন্যই আমি একটা বাড়ি বিক্রি করে ত্যাগ (সেক্রিফাইজ) করলাম।
প্রথম আলো: বনানীর মতো এলাকায় একটি বাড়ি শত কোটি টাকার সম্পদ, একজন ভোটারের মনে তাই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ও তাহলে উনি মেয়র হচ্ছেন ভবিষ্যতে ওই টাকা কোনো না কোনোভাবে উসুল করবেন তাই?
সাঈদ খোকন: এটা ভিন্নভাবেও দেখা যায়। এটাকে আপনি আমার একটা বড় ত্যাগ ভাবতে পারেন। আর যদি আপনি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন, সন্দেহ আসতে পারে। আপনি উভয় দিক থেকেই এটিকে দেখতে পারেন।
প্রথম আলো: আপনি দক্ষিণের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, কিন্তু ঢাকা শহর যেভাবে বিভাজিত হয়েছে আপনি নির্বাচিত হলেন কিন্তু উত্তরে আপনার সঙ্গে চিন্তাভাবনায় মেলে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মেলে এমন কেউ নির্বাচিত হলো না। বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কেউ, ভিন্ন দলের কেউ নির্বাচিত হলো তখন কাজের সমন্বয়ে কি কোনো সমস্যা হবে না?
সাঈদ খোকন: সিটি করপোরেশনের যেসব সার্ভিসেস রয়েছে সেটা ইতোমধ্যেই দুটো করপোরেশনে বিভক্ত হয়ে গেছে। সেখানে যদি আমার মনঃপূত কেউ নাও হয়, সেখানে জটিলতা আমি এখনো দেখতে পাচ্ছি না। পুরো প্রশাসন, অর্থ, হিসাব সব ঠিক হয়ে গেছে। এখানে অন্য যদি একজন মেয়র আসে যার সঙ্গে আমার মতের মিল হবে না তাতে বড় রকমের কোনো চ্যালেঞ্জ আসবে বলে আমি মনে করি না।
প্রথম আলো: আপনার হলফনামায় আপনি যে সম্পদের বিবরণ দিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে আপনার সম্পদের তুলনায় আপনার যে আয়ের বিবরণ সেটি একটু অসংগতিপূর্ণ। আপনার আয় তো খুব বেশি দেখাননি বা দেখা যাচ্ছে না।
সাঈদ খোকন: দেখা যাচ্ছে না, কারণ আয়টা এ মুহূর্তে আমার ঠিক নেই। আমার সম্পত্তির দাম কমেছে (ডি-ভ্যালুয়েশন হয়েছে)। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব বিনিয়োগ ছিল সেগুলোর একটা বড় অংশ মন্দ বিনিয়োগে চলে গেছে। যার কারণে আমার আয় কমে গেছে। সে জন্য হয়তো আপনার সেটা মনে হতে পারে। গত কয়েক বছরে ব্যবসা খুব খারাপ, মন্দা তো আছেই।
প্রথম আলো: তাহলে আপনার ব্যবসার যে মন্দাভাব গেছে যার কারণে আপনার নগদ আয় কমেছে সেই লোকসান কাটাতে মেয়র হওয়ার পর কি আবার ব্যবসায় মনোযোগী হবেন? অর্থাৎ, পার্টটাইম মেয়র ও পার্টটাইম ব্যবসায়ী?
সাঈদ খোকন: না, বিষয়টা এমন না। আমার যেসব ইনভেস্টমেন্ট তা একদম ওপেন আছে। কোনো গোপন বিনিয়োগ নেই। হলফনামায় যেগুলো দিয়েছি সেগুলোই। শেয়ারে বিনিয়োগ রয়েছে, স্থাবর সম্পত্তি, বাড়িভাড়া এগুলো ম্যানেজ করার জন্য ফুলটাইম প্রয়োজন পড়ে না। শেয়ারে বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি। দৈনন্দিন বিষয় নয়। এখানে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়ে না। আমার জেনারেল ইনস্যুরেন্স আছে, সেটি একটি করপোরেট বডি, সেখানে আমার এমডি আছে।
প্রথম আলো: আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা?
সাঈদ খোকন: সেটা অনেকটা কমিয়ে এনেছি। সেখানে আমার বড় ধরনের একটা লোকসান চলে আসছে, সেটা বন্ধের পর্যায়ে। আমাকে যে খুব বেশি একটা সময় দিতে হবে এ রকম না। আমি নিজের সম্পদ ও ব্যবসার আয়ে চলতে পারি। যেভাবে আছি, ভালোই আছি।
প্রথম আলো: রাজনৈতিক দিক থেকে আপনার আদর্শগত বা সাংগঠনিক অবস্থানের ধারাবাহিকতায় ছেদ রয়েছে। এর কারণে আওয়ামী লীগের মধ্যে যাঁরা ত্যাগী, ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগের জন্য আছেন, আপনার সঙ্গে তাদের কি একটা বিশ্বাসের সংকট, আস্থার সংকট তৈরি হয়নি? বিশেষ করে এক-এগারোর পরিবর্তনের পর যখন আপনি সেনা-সমর্থিত দল পিডিপিতে যোগ দিয়েছিলেন?
সাঈদ খোকন: আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের পরে আওয়ামী লীগে যদি হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারের অবদান থাকে, ঢাকার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিকাশের জন্য কোনো পরিবার থাকে সেটা আমার পরিবার। এক, দুই, তিন, বা ২০ বছর না। ১৯৫৪ সাল থেকে। বঙ্গবন্ধুকে যখন হঠাৎ মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো তাঁর বাসা ছাড়তে বলা হলো, তিনি পরিবার নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেলেন। আমার দাদিমা, বড় চাচা তখন তাঁর পরিবারকে আগলে রাখলেন। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমার প্রয়াত পিতা জাতির জনকের সঙ্গে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর আমার বাবার রাজনীতিতে যে অবদান তা দেখেন। নেত্রীর জন্য তিনি জীবন দিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এল, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সেখানে একটি টার্নিং পয়েন্ট।
আমি আমার বিষয়টাতে আসি। ১৯৮৭ সাল, আমি তখন মাত্র কলেজে পড়ি। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ যখন গঠন করা হয়, সে সময় আমাকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। আমি সক্রিয় হই ১৯৯৭-এর দিকে। মাঝখানে যে ঘটনা ঘটল ২৮ নভেম্বর ২০০৬ আমার বাবা মারা গেলেন। বাবা মারা যাওয়ার তিন-চার মাসের মাথায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। আমার বাসায় গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এলেন। আমাকে একটা মামলায় আসামি করলেন। আপনারা জেনে থাকবেন শেরাটন হোটেলের সামনে একটি বাস পোড়ানোর মামলা। প্রায় ১৪ জন নিরীহ মানুষ সেখানে মারা যায়। সে মামলার আসামি করা হলো। বলা হলো রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলতে বলেছে। গান পাউডার নেত্রী আমাকে হাতে তুলে দিয়েছেন। আমি ওদের দিয়ে বাসটা পুড়িয়েছি। এটা নেত্রীর নির্দেশ, এটা আমাকে স্বীকার করতে হবে। আমাকে সাক্ষী দিতে হবে। এটার বিনিময়ে আমাকে রিলিজ করবেন। আমি বললাম এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। এটা আমি পারব না। অন্য কোনো অপশন থাকলে তোমরা বলো। তখন তারা তাদের যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তাতে আমাকে সহায়তা করতে বলে। আমি রাজি হই। সে সময়ে গণমাধ্যমে আমি যে বিবৃতি দিই সেটা তাদের চাপের মুখে। আমি অফিশিয়ালি পিডিপিতে যোগ দিইনি। আমার বিবৃতি জনমনে এবং দলের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি ও অসন্তুষ্টির জন্ম দিয়েছিল। আমার কোনো উপায় ছিল না। আমি ভুল স্বীকার করি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে জননেত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি গ্রহণ করেছেন। আমার সঙ্গে কী হচ্ছে সেটা শেখ হাসিনা জানতেন। আমাকে পার্টির পক্ষ থেকে কোনো শোকজ করা হয়নি।
প্রথম আলো: মাঠপর্যায়ে যাঁরা বিরোধিতা করছিলেন তাঁরা কি এখন আপনার সমর্থনে পুরোপুরি আন্তরিকভাবে কাজে নেমেছেন?
সাঈদ খোকন: আমার তো মনে হয় যে তাঁরা কাজ করছেন। নির্বাচনী গণসংযোগ, জনসভা এসব জিনিসে তাঁদের অংশগ্রহণ আমার চোখে পড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছি, তাঁরা অংশ নিচ্ছেন।
প্রথম আলো: আপনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনার আস্থার সম্পর্কের কথা বললেন। তাহলে কি বিরোধী দলের প্রার্থী নির্বাচিত হলে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে এবং আপনার ক্ষেত্রে হবে না, সেটাই কি বোঝাতে চাইছেন?
সাঈদ খোকন: বিরোধী দলের বিষয়টা তো বিরোধী দলের বিষয়। সিটি করপোরেশন পরিচালনা করতে গেলে আমাদের সরকারের ওপর নির্ভর করতে হবে। সিটি করপোরেশনের যে রাজস্ব আয়, তা করপোরেশন চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থাকে। বিদেশি সাহায্যভুক্ত বিভিন্ন প্রকল্প থাকে। যদি আপনার আশীর্বাদটা থাকে, আপনার সুবিধা থাকবে। আমার ক্ষেত্রে তো অবশ্যই থাকবে। ঢাকা শহরের মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য আমি নেত্রীর কাছে যদি যাই, আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি আমাকে খালি হাতে ফেরত দেবেন না।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সংগঠনেই দেখা যায়, যাঁরা সাধারণত নেতৃত্বের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাঁরা নির্বাচিত হওয়ার পরে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবমূল্যায়ন করেন, উপেক্ষা করেন, এমনকি অবমাননা করেন। আপনি নির্বাচিত হলে করপোরেশন পরিচালনায় আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের কি কোনো ভূমিকা থাকবে?
সাঈদ খোকন: প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে বিএনপি বা মির্জা আব্বাস সাহেবকে বোঝাচ্ছেন? একটা ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিই, আমার বাবা যখন নির্বাচিত হলেন প্রথম দিন তিনি (মজার ব্যাপার হলো আমার সঙ্গে যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি আমার বাবার সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন) তাঁর বাসায় গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁকে মিষ্টিমুখ করালেন। আমার বাবার আগে মির্জা আব্বাস মেয়র ছিলেন। আমার বাবা তাঁকে বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেদিকে যাননি। উনি যেখান থেকে শেষ করেছেন, আমার বাবা সেখান থেকে শুরু করেছেন। ওনার কোনো প্রকল্প আমার বাবা অবমূল্যায়ন করেননি, বন্ধ করেননি, কোনো অভিযোগ আনেননি। আমি সেই বাবার সন্তান। আমরা পারিবারিকভাবে যে শিক্ষা পেয়েছি, তাতে মানুষকে সম্মান করার বিষয়গুলো নিয়েই ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছি।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি বড় সমস্যা, যেটা সবাই বলেন নির্বাচিত হওয়ার পর নেতারা ভোটারদের ভুলে যান। পাঁচ বছর ভোটারদের কথা আর কেউ শুনবেন না। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন, যেকোনো সমস্যা সমাধান বা পরিকল্পনা তৈরিতে নাগরিকদের কথা বলার কী ব্যবস্থা থাকবে?
সাঈদ খোকন: যদি নির্বাচিত হতে পারি, আল্লাহ রাব্বুল-আলামিন যদি আমাকে সে স্থানে নিয়ে যান ঢাকা ডায়ালগের ব্যবস্থা করব। সেখানে ঢাকার সাধারণ জনগণকে নিয়ে শুরু করে সবাই, উন্মুক্ত আলোচনা করবেন। এটা হয়তো খুব ঘন ঘন করা যাবে না। তবে মাসিক বা ত্রৈমাসিকভাবে এটা সম্ভব। ছয় মাসেও একবার সম্ভব।
প্রথম আলো: প্রচারণার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সাঈদ খোকন: আপনাদেরও ধন্যবাদ।