নির্বাচন পর্যন্ত চুপ থাকার নির্দেশ ছিল!

মঞ্চে তখন রেহানা বানু। বলছিলেন, ‘মা সারাটা দিন দরজার দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। ভাবেন, সেলিম রেজা (পিন্টু) এসে বলবে, ‘আমি এসে গেছি মা! দরজা খোলো।’
ঢাকার পল্লবী থেকে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে সেলিমকে তুলে নেওয়া হয়। তিনি সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি। রেহান বানু তাঁর বোন।
রেহানা বানুর বক্তব্য শুনে দর্শকের সারিতে বসা নিলুফার বেগম আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। ছেলে তানভীরের জন্য হু হু করে কেঁদে উঠলেন।
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর তানভীরসহ আটজনকে তিন ভাগে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিখোঁজ ওই আটজনের একজন জাহিদুল করিম ওরফে তানভীর। তানভীরের মা গতকাল শনিবার মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সম্মেলনে এসেছিলেন ছেলের ছবি বুকে ঝুলিয়ে। গাঢ় সবুজ মাঠের ওপর বসে তানভীর কার দিকে যেন তাকিয়ে হাসছে। ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর এই প্রথম প্রকাশ্যে আসা তাঁর।

এই নিখোঁজদের স্বজনেরা জানালেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (৫ জানুয়ারির) নির্বাচন পর্যন্ত চুপ করে থাকতে বলেছিল তাঁদের। কিন্তু আর কত দিন চুপ করে বসে থাকা যায়?
নিখোঁজ আটজনের পক্ষ থেকে সাজেদুলের বোন সানজিদা ইসলাম মঞ্চে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছিলাম র্যাব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিনটি গাড়িতে করে এসেছিল। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা র্যাব অফিসে যাই। আমার বৃদ্ধা মা প্রতি সপ্তাহে র্যাবের ডিজি, এডিজি ও সিইওর দপ্তরে ধরনা দেন। আমার ভাতিজিরা বাবার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। এটা অসহনীয়। আমার ভাইকে হয় ফেরত দিন, নয় উদ্ধার করে দিন। ফেরত দিতেই হবে। উত্তর দিতেই হবে। আমাকে জানতেই হবে ওরা কোথায়? আমাদের ট্যাক্সের পয়সা প্রতিরক্ষা বাহিনী চলে।’
মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেলের বোন নুসরাত জাহান, আসাদুজ্জামানের বোন মিনারা বেগম, এ এম আদনান চৌধুরীর বাবা রুহুল আমিন মাস্টারও কিছু বলতে এসেছিলেন সম্মেলনে। তাঁরা সবাই বিএনপির সমর্থক হলেও সাজেদুল ইসলাম ছাড়া আর কেউ সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না বলে পরিবারগুলোর দাবি।
ঘটনাক্রমে সেদিন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একসঙ্গে ছিলেন সাজেদুল ইসলাম ওরফে সুমন (৩৪), তাঁর খালাতো ভাই জাহিদুল করিম ওরফে তানভীর (৩০)। আরও ছিলেন আবদুল কাদের ভূঁইয়া ওরফে মাসুম (২৪), পশ্চিম নাখালপাড়ার মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেল (২৪), মুগদার আসাদুজ্জামান ওরফে রানা (২৭) ও উত্তর বাড্ডার আল আমিন (২৬)। কয়েক ঘণ্টা পর রাত দুইটার দিকে শাহীনবাগের বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় এ এম আদনান চৌধুরীকে (২৮)। প্রায় একই সময়ে তুলে নেওয়া হয় কাওছার আহমেদকে ।
মাজহারুল ইসলামের বোন নুসরাত জাহান প্রথম আলোকে জানান, তাঁর ভাই বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা পাস করার পর লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। র্যাব সদস্যরা ধারণা দিয়েছিলেন, ওঁরা বেঁচে আছেন। বলেছিলেন, রাজনৈতিক কারণে ধরা হয়েছে। নির্বাচন শেষে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। মে মাস পর্যন্ত একই আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা। এখন আর কথা বলছেন না।
একই কথা বলেন, মিনারা বেগম। তাঁর ভাইও সরকারি চাকরিতে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
এ এম আদনান চৌধুরীর বাবা রুহুল আমিন মাস্টার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত দুইটায় আদনানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় র্যাব সদস্যরা বলেছিলেন, আবার ফিরিয়ে দেবেন। র্যাব কথা রাখেনি। যে র্যাব একটা নবজাতক বাচ্চাকে খুঁজে বের করে দিতে পারে, সেই র্যাব চাইলে কি আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে পারে না? এখন তারা উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা অস্বীকার করে। তাহলে আমার চোখের সামনে যেটা ঘটল সেটা কী?’