নির্মাণপর্বে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প

পূর্বে কোহেলিয়া নদী। দক্ষিণে ও পশ্চিমে বিশাল বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর। জায়গার নাম মাতারবাড়ী। কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নের এই স্থানে বাস্তবায়িত হচ্ছে মাতারবাড়ী সমন্বিত বিদ্যুৎ প্রকল্প। সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১০টি বড় (মেগা) প্রকল্পের একটি।
দেশি-বিদেশি (মূলত জাপানি) মিলে কয়েক হাজার লোকের কর্মব্যস্ততায় সরগরম প্রকল্প এলাকা। ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরেজমিনে প্রকল্পের নির্মাণপর্বের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার কথা। ব্যস্ততা তাই অনেক বেশি। সরকারি খাতের ‘কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড’ (সিপিজিসিবিএল) এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কয়লা আমদানির জন্য একটি টার্মিনাল, কয়লা খালাস ও মজুতের ব্যবস্থা, সমুদ্র থেকে ওই টার্মিনাল পর্যন্ত কয়লাবাহী জাহাজ আনার জন্য ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ১৮ মিটার গভীর ও ২৫০ মিটার প্রস্থ তলদেশের একটি খাল খনন, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য লাইন ও উপকেন্দ্র তৈরি, প্রকল্পসংলগ্ন এলাকায় শহর, সড়ক যোগাযোগ এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন করা হবে।
তবে এখানেই শেষ নয়। এই প্রকল্প এলাকায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য জাইকার সহায়তা চেয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া সিপিজিসিএলের আওতায় ওই এলাকায় আরও ৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও জাপানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই কেন্দ্রগুলো স্থাপনের প্রক্রিয়া চলেছে।
তবে চলমান প্রকল্পটির বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ এর ব্যয় বৃদ্ধি। দ্বিতীয়ত বাস্তবায়নকাল পিছিয়ে যাওয়া। এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৩২ হাজার ৯৯২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে নির্মাণ (ইপিসি) ঠিকাদারের জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২২ হাজার কোটির মতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্মাণ ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকায়।
পরিকল্পনা কমিশনের একটি সূত্র জানায়, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে জমি অধিগ্রহণসহ এই প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে অনেকটাই বাড়বে। শেষ পর্যন্ত তা প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। সে হিসাবে এটি এখন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্প। এর চেয়ে বেশি ব্যয়ের একমাত্র প্রকল্প হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প।
জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। এখন নতুন সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। তবে প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে তাঁরা কাজ শেষ করতে পারবেন।
প্রকল্পটির আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যয় বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নের সময় পিছিয়ে যাওয়ায় এই প্রকল্পের আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে যে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, তা অনেক কমেছে। প্রকল্পটি থেকে যে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন সম্ভব ছিল, তা-ও পেতে বিলম্ব হবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, নানা কারণে অনেক প্রকল্পেরই ব্যয় বাড়তে পারে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করা গেলে সেই ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষতি পোষানো যায়। কিন্তু বিলম্বের ক্ষতি কখনোই পোষানো যায় না।
প্রকল্পটির বাস্তবায়ন পিছিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার নিয়ামক ভূমিকা রয়েছে। এই প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে নির্মাণ ঠিকাদারি পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে অপরিহার্য অংশগ্রহণ জাপানের। হোলি আর্টিজানে হামলার পর জাইকাসহ জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকল্পের কাজে অংশ নেওয়া থেকে প্রায় এক বছর বিরত থাকে। ফলে কাজ পিছিয়ে পড়ে। গত বছর মে মাসে তারা কাজে ফিরে আসে। তারপর নির্মাণ ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলছে।
প্রকল্পের নির্মাণ ঠিকাদার জাপানের সুমিতোমো-তোশিবা-আইএইচআই করপোরেশনের যৌথ উদ্যোগে হওয়া কোম্পানি। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের পুঞ্জীভূত ব্যয় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বাজেটে এই প্রকল্পের জন্য ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল শুক্রবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মাতারবাড়ী প্রকল্পের প্রায় ১ হাজার ৬০০ একর জায়গা এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কয়লা বন্দরের জন্য ব্যবহার করা হবে। পরবর্তী সময়ে এখানে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে।