নিষেধাজ্ঞা থাকলেও লিবিয়া যেতে চান বাংলাদেশিরা

নিরাপত্তার কারণে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ সরকার ছয় মাস ধরে লিবিয়া ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সেখানে বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া বন্ধ রয়েছে। তবে লিবিয়া থেকে যাঁদের ভিসা এসেছে, তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতিতেও সেখানে যেতে চান।

>* নিরাপত্তার জন্য নিষেধাজ্ঞা সরকারের * বায়রা চায় প্রত্যাহার হোক

জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, লিবিয়া থেকে যাঁরা ছুটিতে দেশে আসছেন তাঁরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ ছাড়পত্র নিয়ে আবার যাচ্ছেন। কিন্তু নতুন কর্মীদের ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। বর্তমানে ১৭১টি জনশক্তি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান লিবিয়া থেকে ৫২ হাজার কর্মী পাঠানোর চাহিদা পেয়েছে। ঢাকার লিবীয় দূতাবাস যাচাই-বাছাই করে চার হাজার কর্মীর ভিসাও দিয়েছে। কিন্তু পাসপোর্টে ভিসা লাগার পরও নিষেধাজ্ঞার কারণে তাঁদের যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না সরকার। ফলে ওই ভিসাগুলোর মেয়াদ শেষ হতে চলেছে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণেই লিবিয়া ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আমরা বর্তমান পরিস্থিতিও নজরে রাখছি। যদি মনে হয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক, তখন আমরা আবার কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেব। তবে দেশের মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে গুরুত্ব দেওয়া হবে।’
লিবিয়ায় কয়েক বছর ধরে চিকিৎসক ও নার্স পাঠাচ্ছে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আজুর বেঙ্গল। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী কাজী আবদুল হাকিম বলেন, ‘চিকিৎসক, নার্স, প্রকৌশলীসহ বর্তমানে যেসব বাংলাদেশি লিবিয়ায় আছেন, সবাই খুব ভালো বেতন পাচ্ছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় থেকে কাজ করায় নিয়োগ কর্তারাও বাংলাদেশিদের ওপর খুশি। তাঁরা আরও কর্মী চাইছেন। কিন্তু এখন যদি সরকার কর্মী পাঠানোর অনুমতি না দেয়, তাহলে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হবে।’
নাজ অ্যাসোসিয়েটসের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার নিরাপত্তার কথা বলে নতুন শ্রমিকদের যেতে দিচ্ছে না। কিন্তু লিবিয়া থেকে ছুটিতে যাঁরা আসছেন, তাঁরা কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ছাড়পত্র নিয়ে ঠিকই আবার যাচ্ছেন। এটি দ্বৈত নীতি। আমরা সরকারকে বলেছি, যেসব কর্মী আমরা পাঠাব, প্রয়োজনে তাঁদের বিমা করে দেব। প্রয়োজনে সরকারের প্রতিনিধিদল গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসুক। আর বেনগাজি বাদে লিবিয়ার পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক। দেশটিতে ২০-২৫ হাজার বাংলাদেশি আছেন।’ তিনি বলেন, পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক বলেই পয়লা বৈশাখে ত্রিপোলির বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার বাংলাদেশি গেছেন।
২০০৮ ও ২০০৯ সালে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হলে লিবিয়া হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় বাজার। ২০০৯ ও ২০১০ সালে ৩৫ হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে যান। কিন্তু জাল ভিসায় লোক পাঠানোসহ নানা অনিয়মের কারণে ২০১০ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেশটি। ২০১১ সালে দেশটিতে যুদ্ধাবস্থা শুরুর পর ৩৬ হাজার বাংলাদেশি দেশে ফেরেন। ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে প্রায় ২৬ হাজার বাংলাদেশি আবার দেশটিতে যান। তবে নিরাপত্তার কারণে গত বছর থেকে কর্মী পাঠানো স্থগিত রাখা হয়েছে। জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক দাবি করে আবারও কর্মী পাঠানোর অনুমতি চাইছেন।
বায়রা সূত্র বলেছে, ঢাকার লিবিয়া দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সও বায়রাকে আবার কর্মী পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। বায়রাও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রীকে কয়েক দফা চিঠি দিয়ে আবারও বাংলাদেশিদের ছাড়পত্র দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকেও লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে চিঠি দিয়ে মতামত চাওয়া হয়। তবে এমন অবস্থায় ২৫ মার্চ বেনগাজিতে তিনজন বাংলাদেশি মারা যান। এ ছাড়া অনেক বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে চলে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আবার জটিল হয়েছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব মনসুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার কারণে ভিসা পাওয়া শ্রমিকদের লিবিয়া যাওয়া বন্ধ। এসব ভিসাও মেয়াদোত্তীর্ণ হতে চলছে। আমরা মনে করছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত। নইলে এই বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
লিবিয়ার ভিসা পাওয়া ৭০ জন বাংলাদেশি কর্মী ছাড়পত্রের জন্য রিট আবেদন করলে হাইকোর্ট ৬ এপ্রিল তাঁদের ছাড়পত্র দেওয়ার রায় দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আপিল করলে ১৩ এপ্রিল সেটি খারিজ করে আগের রায় বহাল রাখেন আদালত।
রিটকারীদের পক্ষে মুন্সিগঞ্জের সাইফুল ইসলাম, শরীয়তপুরের তন্ময় মজুমদার, সাতক্ষীরার আবদুল আলিমসহ আরও কয়েকজন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কয়েক লাখ টাকা খরচ করে ভিসা পেয়েছেন। এখন লিবিয়া যেতে না পারলে তাঁরা চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন। হাজার হাজার বাংলাদেশি যেহেতু সেখানে আছেন, কাজেই তাঁরাও যেতে চান। আদালতও তাঁদের পক্ষে রায় দিয়েছেন।
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর আশরাফুল ইসলাম বলেন, দূতাবাস প্রতি মুহূর্তে ঢাকায় প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে। কাজেই সরকারকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনি বিষয়টি আমরা বিবেচনা করছি। তবে আমরা আমাদের কর্মীদের কোনো ঝুঁকির মুখে ফেলতে চাই না। লিবিয়ায় যুদ্ধাবস্থা চলছে। কয়েক দিন আগেও তিনজন বাংলাদেশি মারা গেছেন। কাজেই নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’