নূরলদীনের গ্রাম

মিঠাপুকুরের ফুলচৌকি গ্রামে মসজিদের প্রধান ফটকের সামনে নূরলদীনের কবর।
মঈনুল ইসলাম

‘নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত আর

নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয়, আছে ঊনসত্তর হাজার।’

সৈয়দ শামসুল হকের সাড়াজাগানো ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কবিতাটির শুরুর লাইন এই দুটি। আর শেষে রয়েছে সেই গভীর উচ্চারণ ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়।’ রংপুরের কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া নূরলদীন ছিলেন স্বাধীনতাকামী একজন কৃষক, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রাণপুরুষ। তাঁর আসল নাম ছিল নূরুউদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং। ইংরেজ শাসন উৎখাতে ১৭৬০ থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত অসংখ্যবার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি।

বাংলা অঞ্চল তখন পার করছিল হাহাকারময় সময়। তারপরও অত্যাচার, নিপীড়ন আর লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্জিত টাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবস্থা তখন খুবই রমরমা। রাজস্ব ক্ষমতা হাতে পেয়ে ইংরেজরা তখন চালু করেছিল ইজারাদারি প্রথা। আর এই ইজারাদারি ব্যবস্থায় রংপুর, দিনাজপুরের ইজারাদারি লাভ করেন একজন অত্যাচারী জমিদার দেবী সিংহ। নূরলদীন ও তাঁর বাহিনীর লড়াই ছিল কৃষক স্বার্থবিরোধী এই ইজারাপ্রথার বিরুদ্ধে।

রংপুর জেলা প্রশাসকের সম্পাদনায় রংপুর জেলার ইতিহাস, মুহম্মদ মনিরুজ্জামানের রঙ্গপুরের প্রাচীন ইতিহাস (প্রথম খণ্ড) এবং লালমনিরহাট জেলা তথ্য বাতায়নের ‘ইতিহাসে মোগলহাট ইউনিয়ন’ লেখা থেকে জানা যায় একাধিক সম্মুখযুদ্ধের কাহিনি। তেমনই একটি লড়াই হয়েছিল ১৭৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে। রংপুর-দিনাজপুর, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির (বর্তমানে ভারত) বিদ্রোহী প্রজারা লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে অবস্থান করছিলেন। ইংরেজ-সমর্থিত জমিদাররা তখন প্রাণভয়ে আত্মগোপন করেন।

নূরলদীনের নেতৃত্বে একটি দল পাটগ্রামের মোগলহাটে পৌঁছায়। নূরলদীনের সঙ্গে কতজন সৈন্য আছেন, সেটা আন্দাজ করতে না পেরে ইংরেজ বাহিনী তাদের দুজন সৈন্যকে কৃষকদের পোশাক পরিয়ে নূরলদীন বাহিনীর পেছনে পাঠিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল গোয়েন্দাগিরি করে নূরলদীন বাহিনীর তথ্য জানা। একপর্যায়ে নূরলদীন, প্রধান দুই সহযোগী লালমনি, দয়াশীলসহ তাঁর বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। একজন ইংরেজ সৈন্য পেছন দিক থেকে এসে নূরলদীনকে অতর্কিত আক্রমণ করে বসে। নূরলদীন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। লালমনিসহ অন্যরা তৎক্ষণাৎ নূরলদীনকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। যুদ্ধে দয়াশীল নিহত হন।

আহত নূরলদীনকে তিস্তা নদীতীরবর্তী এলাকায় নিয়ে সেবা করতে থাকেন লালমনি। এদিকে ইংরেজ বাহিনী হন্যে হয়ে নূরলদীনকে খুঁজতে থাকে। উপায় না দেখে গভীর রাতে তিস্তা নদী পার হয়ে রংপুরের মিঠাপুকুরের কাছে ফুলচৌকি গ্রামে নূরলদীনকে নিয়ে যাওয়া হয়, যেটি তাঁর নিজের গ্রাম। আহত অবস্থায় ১৭৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নূরলদীন ফুলচৌকির নিজ বাড়িতে মারা যান। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

রংপুরের মিঠাপুকুরের ফুলচৌকি গ্রামটি রংপুর শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে। অতিসম্প্রতি ফুলচৌকি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, ঝোপজঙ্গলের ভেতর একটি বিধ্বস্ত ইটের দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। এটিই নূরলদীনের বসতভিটার শেষ চিহ্ন বলে জানালেন সেখানকার স্থানীয়রা। তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে ১৮২২ সালে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। গ্রামের নামে এর নামকরণ করা হয়—ফুলচৌকি মসজিদ। ওই মসজিদের প্রবেশপথে শায়িত শহীদ নূরুউদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জং। কবরের পাশে টাঙানো আছে একটি সাইনবোর্ডও।

মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হলেও দীর্ঘ সময় ধরে এটির সংস্কার হয়নি। এখানে কথা হলো নূরলদীনের সপ্তম পুরুষ বলে দাবিদার ফুলচৌকি গ্রামের বাসিন্দা সাজেদুল কবির চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানান, নূরলদীনের মৃত্যুর পর স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে ১৮২২ সালে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়।

একজন নূরলদীন হয়ে আছেন এ অঞ্চলের অগণিত মানুষের প্রেরণার উৎস। আজও নূরলদীনের নামে আপ্লুত হয় অগণিত প্রাণ।