নেপথ্যে তিন কৌশল

>

শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনা

জেলা সফরের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা কার্যত শুরু করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সফর করেননি এমন জেলাগুলোকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এই জেলা সফর অব্যাহত থাকবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

সরকার ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, তিন কৌশল সামনে রেখে আগাম নির্বাচনী প্রচার শুরু করা হয়েছে। তা হলো আগাম নির্বাচনের আবহ তৈরি করে সরকার বিরোধীদের চাপে রাখা, মাঠপর্যায়ে দলের বিশৃঙ্খলা নিরসন এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তি জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে মাঠপর্যায়ে মানুষকে কাছে টানা।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের প্রায় পৌনে দুই বছর বাকি। সারা দেশে নির্বাচনী হাওয়া তৈরি হলে বিএনপিসহ বিরোধীরা এর বাইরে চিন্তা করার সুযোগ পাবে না। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হলে দলটি আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি দিতে পারে। আগে থেকে মানুষকে নির্বাচনমুখী করে রাখতে পারলে আন্দোলনে সফল হতে পারবে না বিএনপি। নির্বাচন নিয়ে আগাম দৌড়ঝাঁপ শুরুর পেছনে এই বিবেচনাও কাজ করেছে।

দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগ খুবই বিশৃঙ্খল, কোন্দলে জর্জরিত। প্রধানমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনী প্রচার নিয়ে মাঠে নামলে এই কোন্দল কমে আসবে। পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। পাঁচ শতাধিক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

অবশ্য কোন্দল মিটিয়ে ফেলতে বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। ২ মার্চ জেলা পর্যায়ের নেতাদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, এখন থেকে প্রয়োজন হলে শুধু কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ বহিষ্কার করবে। এই চিঠির মাধ্যমে মূলত নির্বাচনের আগে ছোট অপরাধে কাউকে দল থেকে বের না করার কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।

.
.

তৃতীয়ত, দলের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন ও গবেষণা বলছে, দল ও সরকারের চেয়ে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেশি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে ১২৭ জন আওয়ামী লীগের, যাঁদের অনেকে জীবনে প্রথম সাংসদ হয়েছেন। ফলে তাঁদের জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা পরীক্ষিত নয়। তাই প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে চান দলের নীতিনির্ধারকেরা।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা উপরে আল্লাহ আর নিচে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখি। আগে হোক পরে হোক মানুষের কাছে যেতেই হবে। এ জন্য নেত্রী ও আমরা সবাই মানুষের কাছে ছুটে যাচ্ছি। আমরা প্রচুর উন্নয়ন করছি, সেটা মানুষ দেখছে এবং আমরা গিয়েও জানাচ্ছি।’

দলীয় সূত্র জানায়, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগের মতো জেলায় জেলায় সফর করে ভোট চাইতে পারবেন না। নির্বাচনী আইন ও বাস্তব কারণেই তা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রচারের জন্য প্রধানমন্ত্রী বড়জোর ৭০ সপ্তাহ সময় পাবেন। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও ফোরামের বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রীকে অংশ নিতে হবে। এ জন্য সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি আগেই শুরু করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, গত বছরের ২২ ও ২৩ অক্টোবর কেন্দ্রীয় জাতীয় সম্মেলন থেকেই মূলত জাতীয় নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি শুরু হয়। সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আসা নেতাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেন দলীয় প্রধান। এরপর সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। চলতি মাসে মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ ও তাঁতী লীগের সম্মেলন হয়েছে।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখে বিএনপি ও জামায়াত-অধ্যুষিত জেলাগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এসব জেলায় সফর করবেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদেরও বিএনপি ও জামায়াত-অধ্যুষিত জেলায় বারবার সফরের নির্দেশনা দিয়েছেন।

দলটির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, জাতীয় পার্টি-অধ্যুষিত উত্তরের জেলাগুলোতে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় নানা কর্মসূচি-পরিকল্পনা করে অবস্থান সংহত হয়েছে। বিএনপি-অধ্যুষিত জেলাগুলোতেও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি ও সমর্থন বেড়েছে।

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, এত দিন সরকারি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জেলা সফর করেছেন। এর ফাঁকে কিছু স্থানে রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও যোগ দিয়েছেন। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে সরকারি কর্মসূচির মতোই কিছু জেলায় রাজনৈতিক সমাবেশ বা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে ভোট চাইবেন।

চলতি মাসে বগুড়ার সান্তাহার, লক্ষ্মীপুর ও মাগুরা সফর করেছেন। এ দুই স্থানে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প চালু ও কাজের উদ্বোধনের পাশাপাশি তিনি দলীয় উদ্যোগে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা করেন। তাতে তিনি নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্মীপুরে গেছেন প্রায় ২০ বছর পর। বগুড়ায় প্রধানমন্ত্রী আগেও গেছেন। তবে বিএনপি-অধ্যুষিত এই জেলায় অবস্থান জোরদার করতে পুনরায় সান্তাহারে যান। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী মাগুরা সফর করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ফরিদপুরে যাওয়ার কথা চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে। আগামী মাসে তাঁর তিনটি জেলা সফর করার কথা রয়েছে। এই জেলাগুলো হচ্ছে ঠাকুরগাঁও, বরগুনা ও চুয়াডাঙ্গা। এসব জেলায় সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের উদ্বোধনের পাশাপাশি দলীয় সমাবেশে অংশ নেবেন তিনি।

সরকার ও আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ফরিদপুর গিয়েছিলেন। প্রায় দুই দশক আগে সফর করেছিলেন ঠাকুরগাঁও ও চুয়াডাঙ্গায়। বরগুনায় ২০১২ সালে সরকারি সফরে গিয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশের ৬৪টি জেলাতেই যাবেন। এ পর্যন্ত ৯টি জেলার কর্মসূচি ঠিক হয়েছে। সব জেলায় যেতে এক বছরেরও বেশি সময় লাগবে।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী, মেয়াদ শেষের তিন মাস আগে থেকে মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নির্বাচনের সময় বাকি আছে আরও প্রায় পৌনে দুই বছর।

এত আগে থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনের প্রস্তুতি ও প্রচার শুরু করার কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী খুবই ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু তাঁকে দলও দেখতে হয়। তাই আগে থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু না করলে সময় পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, দলের অন্য নেতারাও নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন। সবাই যাঁর যাঁর নির্বাচনী এলাকায় কাজ করছেন।