নৌযানের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত সুলতানা কামাল সেতুস্তম্ভ

নৌযানের ধাক্কায় নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতুর স্তম্ভ। ১৮ জানুয়ারি ডেমরা ঘাট থেকে ছবিটি তুলেছেন হাসান রাজা
নৌযানের ধাক্কায় নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতুর স্তম্ভ। ১৮ জানুয়ারি ডেমরা ঘাট থেকে ছবিটি তুলেছেন হাসান রাজা

রাজধানীর ডেমরায় সুলতানা কামাল সেতুর নিচে অবৈধভাবে ইট, পাথর ও বালুর বাণিজ্য চলছে। এসব মালামাল বহনে ব্যবহৃত নৌযানের ধাক্কায় সেতুর পাঁচটি স্তম্ভের নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে গেছে। এখন এই ধাক্কা সরাসরি সেতুর স্তম্ভে লাগছে। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে৷

সুলতানা কামাল সেতুর নিচে নদীর পাড় থেকে লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস লিমিটেড (প্রায় ২৫০ মিটার) পর্যন্ত এলাকায় গদিঘর বসিয়ে চলছে ইট, বালু ও পাথরের এই বাণিজ্য। ১৮ জানুয়ারি দুপুরে সরেজমিন এই রমরমা বাণিজ্য দেখা গেছে।

২০১০ সালে প্রায় ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর সংযোগস্থলে সুলতানা কামাল সেতু নির্মাণ করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭২ মিটার ও প্রস্থ ১০ মিটার। এই নদীর তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সেতুর তত্ত্বাবধায়ক সড়ক ও যোগাযোগ অধিদপ্তর। নদীর এক পারে ডেমরা,
অন্য পারে কাঁচপুর। এই সেতু দিয়ে রূপগঞ্জ, নরসিংদীসহ বৃহত্তর সিলেটের বিপুলসংখ্যক যানবাহন প্রতিদিন চলাচল করে।

বিআইডব্লিউটিএ এবং সড়ক ও যোগাযোগ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্তম্ভের নিরাপত্তাবেষ্টনীগুলো ভেঙে যাওয়ায় সেতুটি অনেক ঝুঁকিতে রয়েছে৷ এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাঁরা এ কথা বললেও অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না কেউই।

বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করা হলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৮ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, সেতু এলাকা পরিদর্শন করতে ঢাকা সার্কেলের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে গত শুক্রবার (২০ জানুয়ারি) বিকেলেও সেতুর নিচে ওই ব্যবসার একই চিত্র দেখা গেছে৷

পাঁচটি স্তম্ভের নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে গেছে

সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর ভেতর পাঁচটি স্তম্ভের নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে রয়েছে৷ এর মধ্যে তিনটি স্তম্ভের বিভিন্ন অংশ খসে পড়েছে৷ একটিতে ফাটল ধরেছে৷ বড় বড় মালবাহী জাহাজ নদীতে চলাচল করছে৷ এর মধ্যে সেতুর পশ্চিম অংশে নদীর পাড়ের স্তম্ভটির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ৷ এটির নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এই স্তম্ভের সঙ্গেই আবার ইট, পাথর ও বালুর বড় চারটি নৌযান মোটা রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। এতে স্তম্ভটির কয়েকটি স্থানে খসে পড়েছে৷ এসব মালামাল নৌযান থেকে সেতুর নিচে পৃথক স্থানে ফেলছেন অর্ধশতাধিক শ্রমিক। পাশে আরেকটি নৌযান থেকে যন্ত্রের সাহায্যে নদীর তীরের প্রায় ১০০ মিটার দূরে বালু ফেলা হচ্ছে৷ এখান থেকে ২০টি ট্রাকে ওঠানো হচ্ছে সেই বালু। এসব ট্রাক সেতুর স্তম্ভ ঘেঁষে রাখা। ফলে ট্রাকের ধাক্কায়ও সেতুর স্তম্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া এই ব্যবসার কারণে সেতুর নিচে বিআইডব্লিউটিএর লাগানো শতাধিক চারাগাছ মরে গেছে।

এই সেতু এলাকার বিভিন্ন স্থানে নামবিহীনভাবে রয়েছে প্রায় ৩০টি গদিঘর ও দোকান। যাঁরা বালুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁদেরই লোকজন এসব দোকান থেকে চাঁদা তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ভয়ে এ বিষয়ে কোনো দোকানি মুখ খোলেননি। এ ছাড়া কারা এই এলাকায় ব্যবসায় জড়িত, তা জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা ও কর্মচারীদের বেশির ভাগই মুখ খুলতে রাজি হননি।

শাসক দলের নেতা-কর্মীরা বালু ব্যবসায়ী

বিআইডব্লিউটিএর একাধিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় চারজন বাসিন্দা বলেন, সুলতানা কামাল সেতু নির্মাণের অনেক আগে থেকেই এই এলাকায় চালু ছিল বালু ব্যবসা। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের স্থানীয় নেতাদের দখলে চলে যায় এই ব্যবসা। বর্তমানে যাঁরা বালুর ব্যবসা করছেন, তাঁরা স্থানীয় সাংসদ হাবিবুর রহমান মোল্লার আত্মীয় ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতা হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে সাংসদের বড় ছেলে মশিউর রহমান মোল্লাও রয়েছেন। মাঠপর্যায়ে তা পরিচালনা করেন ডেমরা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান ওরফে হাসু।

জানতে চাইলে সাংসদ হাবিবুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘ডেমরার সব বালু ব্যবসায়ী দলের নেতা-কর্মী৷ তাই তাঁদের কিছু কইতেও পারি না। তবে এই ব্যবসার কারণে সেতুর কোনো ক্ষতি হয় না। নেতা-কর্মীরা সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবসা করছেন।’ নিজের ছেলের ব্যবসার বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁর ছেলে বালু ব্যবসা করেন না।

সুলতানা কামাল সেতুর নিচে একটি চায়ের দোকানে বসে গল্প করছিলেন ডেমরার সারুলিয়ার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, সারা বছর এই সেতুর নিচে ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। বর্ষায় জাহাজের ধাক্কায় স্তম্ভগুলোর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, অবিলম্বে এই এলাকায় বালু ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

চার বছর ধরে সুলতানা কামাল সেতুর নিচে বালুর ব্যবসা করেন বজলুর রহমান। তিনি নিজেকে সাংসদ হাবিবুর রহমান মোল্লার কর্মী বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দল করি। সরকারি জায়গায় আমরা ব্যবসা করব, এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া আছে।’

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, সবশেষ ২০১৫ সালের ২৮ আগস্ট এই ‘ব্যবসাকেন্দ্র’ উচ্ছেদ করেছিল তারা। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই আবার তা দখল হয়ে যায়।