নয় মাসের তদন্তেও কিছু জানতে পারেনি পুলিশ

এ বছরের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ এম এ লতিফের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার অভিযোগ ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রবল সমালোচনার মুখে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে ছবি বিকৃত করার দায় চাপান গ্রাফিক ডিজাইনারের ওপর। এ ঘটনায় ক্ষমা চান ডিজাইনার। কিন্তু ফেস্টুনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃত করা হয়েছে কি না, নয় মাস তদন্তের পরও তা জানতে পারেনি পুলিশ।
ফেস্টুনে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার অভিযোগে সাংসদ লতিফের বিরুদ্ধে গত ৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে মানহানির মামলা করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক উপপরিবেশ-বিষয়ক সম্পাদক আবদুর রহিম। নয় মাস তদন্তের পর সাংসদ লতিফের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রামের পরিদর্শক মো. মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী প্রতিবেদন দেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘তদন্তে ছবি বিকৃতির সত্যতা পাওয়া যায়নি। তদন্ত করতে গিয়ে কোনো ফেস্টুন পাওয়া যায়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে এটি প্রমাণ করা সম্ভব নয়।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাংসদ এম এ লতিফ ইচ্ছাকৃতভাবে বা তাঁর সরাসরি ইন্ধনে ফটোশপ বা অন্য কোনো মাধ্যমে ছবিটি সম্পাদনা করে বিকৃত করা হয়নি। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় তাঁর (সাংসদ লতিফ) বিরুদ্ধে মানহানির ঘটনা প্রমাণিত হয়নি। বিকৃত ছবিসহ ফেস্টুন বহনকারীদের পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় তাঁদের শনাক্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি।
মামলার বাদী আবদুর রহিম বলেন, পিবিআইয়ের দেওয়া প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তিনি আদালতে নারাজি দেবেন।
এ বিষয়ে সাংসদ এম এ লতিফ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা হওয়ার আদালতে হবে। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না।’
গত ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চট্টগ্রাম সফরকে ঘিরে নগরের আগ্রাবাদ ও বিমানবন্দর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ ফেস্টুন লাগানো হয়। সাংসদ এম এ লতিফের উদ্যোগে এসব ফেস্টুন লাগানো হয়। কিন্তু ফেস্টুনে বঙ্গবন্ধুর শারীরিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে বলে বিতর্ক শুরু হয়। ফেস্টুনে ব্যবহার করা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির মুখমণ্ডল বঙ্গবন্ধুর হলেও শরীর তাঁর নয় বলে অভিযোগ ওঠে।
নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের মুখে ৭ ফেব্রুয়ারি আগ্রাবাদের বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্রের বঙ্গবন্ধু সম্মেলনকক্ষে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ছবি বিকৃতির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাপাখানা প্রতিষ্ঠানের ডিজাইনারকে দায়ী করেন সাংসদ লতিফ। সংবাদ সম্মেলনে ডিজাইনার কবির হোসেন ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান।
এ সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘তদন্তে এ বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।’
এ ঘটনাটি কেন্দ্র করে ১৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘির ময়দানে এক প্রতিবাদ সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার জন্য সাংসদ লতিফকে দায়ী করেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি সাংসদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন এবং তাঁর সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানান।
বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার অভিযোগে ফেব্রুয়ারি মাসে সাংসদ লতিফের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে চারটি মামলা হয়। দুটি মামলার তদন্ত এখনো শেষ করেনি পুলিশ। আরেকটি মামলায় অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি প্রতিবেদন দেওয়ায় সিআইডিকে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।
৪ ফেব্রুয়ারি সাংসদ লতিফের বিরুদ্ধে আদালতে মানহানির দুটি মামলা হয়। প্রথম মামলার প্রতিবেদন মঙ্গলবার জমা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় মামলাটি করেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ। এ মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. জসীম উদ্দিন।
৯ ফেব্রুয়ারি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে সাংসদ লতিফের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন সাইফুদ্দিন আহমেদ।
তদন্ত শেষে পাঁচলাইশ থানার তৎকালীন পরিদর্শক গিয়াস উদ্দিন ২১ মার্চ এ মামলার প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিকৃত ছবি প্রচার কিংবা প্রকাশিত হওয়ার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরপর ২৪ এপ্রিল বাদী আদালতে নারাজি দিয়ে সিআইডি কিংবা র্যা বকে দিয়ে তদন্তের আবেদন করেন। আদালত সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। তবে মামলার বাদী সাইফুদ্দিন আহমেদের দাবি, প্রতিবেদন দিতে পুলিশ গড়িমসি করছে।
৯ ফেব্রুয়ারি সাংসদ লতিফের বিরুদ্ধে ছবি বিকৃত করার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে আরেকটি মামলা করেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কে এম বেলায়েত হোসেন। মামলাটি তদন্ত করছেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসীম উদ্দিন। কবে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
ফেস্টুনে ছবি বিকৃতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম। তিনি সাংসদ লতিফের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি তুলে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতকারী যে-ই হোক, তার বিচার হতে হবে।