পঙ্গু লিমন বনাম রাষ্ট্র

লিমন হোসেন
লিমন হোসেন

দুই বছর আগে র‌্যাব গুলি করেছিল ১৬ বছরের কিশোর লিমনকে। পরিণতিতে তার এক পা কেটে ফেলতে হয়। এর পরও নিস্তার পায়নি সে। গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা দিয়েছে র‌্যাব। সেই দুই মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের গরিব পরিবারে জন্ম নেওয়া নিরীহ এই কলেজছাত্রের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিষ্ঠুরতার ঘটনা সারা দেশের মানুষকে নাড়া দেয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র আরও উঠেপড়ে লাগে পঙ্গু এই কিশোরের বিরুদ্ধে।উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্তি এবং সাধারণ মানুষের আর্থিক সহায়তায় এক বছর ধরে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে কৃত্রিম পা নিয়ে আবার লেখাপড়ায় ফিরে গেছে লিমন। সেটাও মানুষের সহায়তায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাহিনীর করা দুটি মামলার খড়্গ এখন তার ঘুম হারাম করে দিয়েছে। এ দুটি মামলায় পুলিশ লিমনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে। অভিযোগপত্র দুটি আদালত গ্রহণও করেছেন। এই মানসিক চাপ ও যন্ত্রণা নিয়ে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে সে।নথিপত্রে দেখা যায়, দুটি অভিযোগপত্রেই মূলত র‌্যাবের লেখা এজাহারকে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দার তার দলবল নিয়ে রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে পুরোনো জমাদ্দারহাট শহীদ জমাদ্দারের বাড়িতে বৈঠক করছিল।গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব সেখানে অভিযান চালায়। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা র‌্যাবের ওপর গুলিবর্ষণ করে, র‌্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেলে ঘটনাস্থলে লিমনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। তার পাশেই পাওয়া যায় আমেরিকার তৈরি একটি পিস্তল ও একটি গুলির খোসা। আর এভাবে বন্দুকযুদ্ধ করে সরকারি কাজেও বাধা দিয়েছে লিমন।ঝালকাঠির আদালতে লিমনের আইনজীবী নাসির উদ্দিন কবির প্রশ্ন তুলে বলেন, র‌্যাবের কথিত ঘটনার সময় লিমন ১৬ বছরের এক কিশোর, র‌্যাব তাকে গুলি করে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রাখে। তখন সে সরকারি কাজে বাধা দিল কীভাবে?

লিমনের আইনজীবীরা জানান, র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে যতগুলো কথিত ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ বিবরণ দেওয়া হয়েছিল, লিমনের ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম বিবরণ দিয়ে মামলা করা হয়। অথচ যে কথিত সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারের কথা বলা হচ্ছে, তাকে বা ওই কথিত বন্দুকযুদ্ধে জড়িত অপর কাউকে আজ পর্যন্ত র‌্যাব গ্রেপ্তার দেখাতে পারেনি।

লিমনের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তাঁকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র ও স্থানীয় কয়েকজন আইনজীবী বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা দিচ্ছেন।

লিমনকে নিয়ে যা হলো

২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপেজলার সাতুরিয়া গ্রামে র‌্যাবের গুলিতে আহত হয় লিমন। এ কারণে ওই বছর সে আর এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি।

লিমনের অভিযোগ, বাড়ির পাশের মাঠ থেকে গরু আনতে গেলে র‌্যাবের সদস্যরা তাকে ধরে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। পরে গ্রামবাসী চাঁদা তুলে তার চিকিৎসার খরচ চালান। একপর্যায়ে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে লিমনকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা লিমনের জীবন বাঁচাতে তার বাম পা ঊরুর নিচ থেকে কেটে ফেলেন।

এ ঘটনার পর বরিশালে র‌্যাব-৮-এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) লুৎফর রহমান বাদী হয়ে লিমনসহ আটজনের নামে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করেন। একটি অস্ত্র আইনে, অপরটি সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে।

এরপর প্রথম আলোতে ‘চরম নিষ্ঠুরতা’ শিরোনামে ওই বছরের ৬ এপ্রিল এ-সংক্রান্ত খবর ছাপা হয়। এরপর অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও লিমনের ওপর নিষ্ঠুরতার খবর প্রকাশিত হয়। লিমনের এ ঘটনা মানবিকবোধসম্পন্ন সব মানুষকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। এরপর লিমনকে সন্ত্রাসী প্রমাণের জন্য নানা তৎপরতা চলে। স্থানীয়ভাবে র‌্যাবের সোর্স হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরা লিমনের গ্রামে গিয়ে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও লিমনের পক্ষে গণমাধ্যমে কথা বলা মানুষকে হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। এমনকি এসব কথিত সোর্স ও সেখানকার সরকারদলীয় কিছু নেতা-কর্মী তদন্তে যাওয়া বিভিন্ন সংস্থার কাছে লিমনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যও দেন। এসব তৎপরতার কথাও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

মায়ের করা মামলার অপমৃত্যু

অন্যদিকে গুলিবর্ষণকারী র‌্যাবের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে লিমনের মা হেনোয়ারা বেগমের করা মামলা প্রথমে রাজাপুর থানার পুলিশ নেয়নি। পরে তিনি ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে যান। আদালতের নির্দেশের পরও পুলিশ মামলা নেয়নি। উল্টো মামলা না নিতে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা করে পুলিশ, যা ‘নজিরবিহীন’ উল্লেখ করে জজ আদালত পুলিশের এ রিভিশন খারিজ করে দেন। এরপর বাধ্য হয়ে আদালতের নির্দেশে পুলিশ মামলা নেয়। কিন্তু পরে হেনোয়ারা বেগমের করা মামলাটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে শেষ করে দিয়েছে পুলিশ।

এ চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করলে সেটাও খারিজ করে দেন ঝালকাঠির ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে জজ আদালতে রিভিশন দায়ের করেছেন হেনোয়ারা বেগম। আগামী ১৩ জুন রিভিশনের শুনানির দিন ধার্য আছে।

মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের বক্তব্য

২০১১ সালের ১৯ মে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক বাছাই করা কিছু সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে লিমনের ঘটনা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, লিমন সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। এমনকি তার বাবাও সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারের বাহিনীর সঙ্গে জড়িত।

এক দিন পর ২১ মে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টার বক্তব্যকে সরকারের বক্তব্য বলে মন্তব্য করেন।

তার পরদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘উপদেষ্টার (তারিক আহমেদ সিদ্দিক) এ বক্তব্যকে সম্মানের সঙ্গে দেখা উচিত এবং তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সরকারের বক্তব্য বলেই গণ্য করা উচিত।’

সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের এসব বক্তব্যের পর ওই বছরের ২৩ মে র‌্যাবের পক্ষ থেকে সম্মেলন করে বলা হয়, লিমন ও তার বাবা-মা, ভাইবোন সবাই সন্ত্রাসী।

মামলার সর্বশেষ অবস্থা

আদালতের নথিপত্রে দেখা যায়, র‌্যাবের করা অস্ত্র মামলায় লিমনসহ আটজনকে আসামি করে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ওই বছরের ৩ জুলাই ঝালকাঠির বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগপত্র গ্রহণ করে। মামলাটি বর্তমানে অভিযোগ গঠনের অপেক্ষায় আছে।

লিমনের আইনজীবী মানিক আচার্য্য বলেন, অস্ত্র মামলা থেকে লিমনের অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। এই আবেদন ও অভিযোগ গঠনের জন্য ২৯ মে শুনানির দিন ধার্য আছে।

সরকারি কাজে বাধাদানের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয় গত বছরের ১ জুলাই। সর্বশেষ ৭ মে এ অভিযোগপত্র আদালত আমলে নেন। ৩০ মে মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক মো. নূর খান মনে করেন, এ দুটি মামলায় বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার মাধ্যমে পুনঃতদন্ত করা হলে লিমন নির্দোষ প্রমাণিত হবে। তিনি বলেন, এত অল্প বয়সের একটি ছেলের সঙ্গে র‌্যাব ও পুলিশ যে আচরণ করেছে, তা কোনো সভ্য সমাজে আশা করা যায় না। সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তারা লিমনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবছে। সরকার উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও মানছে না। আদালত লিমনের চিকিৎসা খরচ বহন করার নির্দেশ দিয়েছিল, কিন্তু সরকার তা মানেনি।