পঞ্চাশে ব্র্যাক: দায়বদ্ধতা, প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যকর হয়ে ওঠার লক্ষ্যে অভিযাত্রা

নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার অসহায় নারীদের সচেতন করার পাশাপাশি সেবা দিতে ব্র্যাক ১৯৮৬ সালে মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচি চালু করে

স্যার ফজলে হাসান আবেদ – আবেদ ভাই ২০১৯-এর শেষে যখন জীবন থেকে প্রস্থান করলেন স্বদেশ ও বিদেশ থেকে স্বীকৃতি, স্মরণ ও প্রশংসার ঢেউ বয়ে যেতে লাগল। বস্তুত, এ সবই পাওনা ছিল তাঁর। স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর সময় আবেদ ভাই ব্র্যাকের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী পাঁচটি দশকজুড়ে তাঁর ক্লান্তিহীন চেষ্টা এবং গভীর চিন্তাপ্রসূত দিকনির্দেশনা ব্র্যাককে সামাজিক পরিবর্তন সাধনের এক অমিত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের রূপ দিয়েছে। ব্র্যাকের বিপুল এই সামর্থ্য বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু প্রতিষ্ঠান এবং সমাজে সকলের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরের শোকাবহ মাসগুলোতে বিশেষ করে সমাজের সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়াই আমার মধ্যে ভাবনার সঞ্চার করেছে বেশি। এইসব মানুষের সঙ্গে আবেদ ভাইয়ের সরাসরি কোনো সংযোগ ছিল না। এমন অনেককে আমি বলতে শুনেছি – ‘একজন ভাল মানুষ চলে গেলেন, যিনি সারাজীবন সাধারণ মানুষের জীবনে উন্নতি আনার জন্য চেষ্টা করে গেছেন’।

পঞ্চাশ বছরের মাইলফলক পার হওয়ার এই মুহূর্তে আমার কাছে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে তা হলো, আবেদ ভাইয়ের ‘নিয়ত’। এই নিয়ত – লক্ষ্য ও দায়বদ্ধতার এই বোধের প্রথম স্ফুরণ ঘটেছিল ১৯৭০-এর প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোনে, ভোলার ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। প্রতিশ্রুতি ও দায়বদ্ধতার এই বোধ ব্র্যাকের ধারাবাহিক কর্মসূচি এবং প্রাতিষ্ঠানিক অভিযাত্রায় বারবার অনুরণিত হয়েছে। উন্নয়নের টেকনোক্রেটিক আলোচনা-পর্যালোচনায় প্রতিশ্রুতি ও লক্ষ্যে স্থির থাকার এই বিষয়টি প্রায়শই বাদ পড়ে যায়। অথচ, কেন আমরা ‘উন্নয়ন’ খাতে কাজ করছি সেই প্রশ্নটির উত্তর এবং পরম অধ্যবসায়ের সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়া ও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বের করে নিয়ে আসা - এসবের পেছনে কাজ করছে সেই প্রতিশ্রুতি ও স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার নিয়ত। আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগের শুরু সেই ১৯৯০-এর দশকে হলেও তার মাত্রা খুব বেশি ছিল না। সীমিত এই ভাব বিনিময়ের মধ্য দিয়ে তাঁর যে বীক্ষাটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে তা হলো - সুবিধাবঞ্চিত সেইসব মানুষ, যাঁরা নানামুখী প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক বাধার কারণে নিজেদের সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারছেন না, তাঁদের প্রতি তাঁর কর্তব্য ও দায়বদ্ধতার এক অনড় বোধ। প্রস্থানপূর্ব শেষ মাসগুলোতে সেই তাগিদ যেন আরো প্রবল হয়েছিল। সেসময়টায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্র্যাকের ওপরে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল, কিন্তু যে স্থির লক্ষ্য, যে মিশন প্রতিষ্ঠানটিকে অর্থপূর্ণ করেছে, তারই আরো শক্তিশালী রূপ তিনি সঞ্চারিত করে দিতে চেয়েছেন শেষ প্রস্থানের আগে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ত্রাণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ব্র্যাকের যাত্রা শুরু। কিন্তু পরিস্থিতি যেমন বদলায় তেমনি প্রয়োজনও বদলায়। পরের ৪০ বছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদচারণা ঘটেছে ব্র্যাকের। কিন্তু এই পদচারণা কোনো অর্থে এলোপাতাড়ি ছিল না। তৃণমূলের কথা শোনার প্রতি আবেদ ভাই সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি সহজ এবং মৌলিক। যার জীবনে আপনি পরিবর্তন আনতে চান তার কথাই যদি না শোনেন, তাহলে কী করে বুঝবেন কোথায় এবং সবচেয়ে কার্যকর কোন উপায়ে নিজের মনোযোগ ও শক্তি ব্যয় করবেন? আশির দশকে শিশুমৃত্যু রোধে ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে সফল উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে নারীদের বেশি সন্তান গ্রহণের পেছনের যে কারণ সেটারও যৌক্তিক সমাধান হয়েছিল। তাঁরা ছয়-সাতটি করে সন্তান নিতেন কারণ, তাতে শেষ পর্যন্ত কয়েকটি বাঁচার সম্ভাবনা থাকত। শিশুমৃত্যু কমে যাওয়ায় তাঁদের সন্তান হারানোর উদ্বেগ কমে এল। সন্তান সংখ্যা কমে আসায় নারীর ওপর সাংসারিক চাপও বেশ খানিকটা লাঘব হলো। এর ফলে নতুন ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার অবসর মিলল তাঁদের। নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ বাড়ল এতে। ১৯৯০এর দশকে এসে সরকার থেকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন জোরদার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। গ্রাম পর্যায়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যের কারণে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে থেকে যাওয়া শিশুদের বিষয়টি তখন উন্মোচিত হলো। আবেদ ভাইয়ের নেতৃত্বে ব্র্যাক তখন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করার মাধ্যমে সেই সমস্যা সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ব্র্যাকের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দক্ষতা উন্নয়নের ক্লাস করছেন তরুণরা

আবেদ ভাই শুধু মাঠের মানুষের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন না, ব্র্যাকের কাজে দিকনির্দেশনা দিতে পারে এমন গবেষণার প্রতিও প্রখর মনোযোগ ছিল তাঁর। যুক্তিপূর্ণ গবেষণার পর্যবেক্ষণ ও ফলাফলের জন্য তিনি ব্র্যাকের ভেতরে ও বাইরে অনুসন্ধান করতেন। নব্বইয়ের দশকে আমার নেতৃত্বে পরিচালিত দারিদ্র্য বিষয়ে গবেষণা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব পর্যবেক্ষণ আহরণ করতেন, একথা আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন আবেদ ভাই। ক্ষুদ্রঋণের বাইরে থেকে যাওয়া অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ ঘটেছে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সুবিধার বাইরে থেকে যাচ্ছে এমন জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন কর্মসূচি পরিকল্পনায় এসব পর্যবেক্ষণ কাজে লেগেছিল বলে জানিয়েছিলেন।

পরবর্তীকালে আবেদ ভাইয়ের দিকনির্দেশনা এবং তাঁর কর্মীদের নিবেদিত শ্রমের ফসল অতিদরিদ্র কর্মসূচি এবং ব্র্যাক ব্যাংক সংস্থাটির উজ্জ্বল অর্জন হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই দুটি কর্মসূচি উল্লিখিত দুই ধরনের জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন পূরণ করেছে। একইভাবে ব্র্যাকের ব্যবসা উদ্যোগগুলোও গড়ে উঠেছে আরেক বঞ্চিত জনগোষ্ঠী গ্রামীণ কারুশিল্পীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের ফসল হিসেবে। শিল্পদক্ষতা আছে কিন্তু বাজারব্যবস্থায় প্রবেশ নেই, এই জনগোষ্ঠীর এমন একটি অবস্থা ছিল সেসময়। কীভাবে ব্র্যাক বাজারব্যবস্থার বহুমাত্রিক দিকগুলোকে অনুধাবন করার মাধ্যমে গ্রামীণ কারুশিল্পীদের জন্য স্থিতিশীল জীবিকার সংস্থান করতে সক্ষম হলো, শুধু তাই নয়, এসব পণ্যের নতুন সব বাজার তৈরিতে ভূমিকা নিল ও ক্রমে বাজারের নেতৃত্বই তার হাতে চলে এল, সে এক বিস্ময়কর উপাখ্যান। এই উপাখ্যান থেকে চমকপ্রদ সব শিক্ষা নেওয়ার আছে যা অন্যত্রও প্রয়োগ করা সম্ভব।

আজ যখন পঞ্চাশের মাইলফলক পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের চাহিদা ও অগ্রাধিকারের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে আমাদের। প্রাসঙ্গিকতার গুরুত্ব অতীতের তুলনায় কোনো অংশে কম নয় আজ। কৌশলগত চারটি চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, যুবশক্তি এবং কৃষি। এর কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্র্যাক ইতিমধ্যে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। সামনে আরো চ্যালেঞ্জ আসতে চলেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ব্র্যাক কর্মীদের এক টাউনহল সভায় আমরা দুজন উপস্থিত ছিলাম। আবেদ ভাই সেদিন জোর দিয়ে বলেছিলেন, সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। তার কয়েক মাস পরই বিশ্বে কোভিড-১৯ অতিমারী আঘাত হানল। অস্তিত্ব সংকটের দুটি বছর পার করে এলাম আমরা। কিন্তু সম্ভবত মানসিক স্বাস্থ্য সংকটই অতিমারীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব হিসেবে আবির্ভূত হবে। এর সঙ্গে বিশ্বব্যাপী সমাজ, সরকার, প্রতিষ্ঠান, এমন কী ব্যক্তিকেও লড়াই করতে হবে। আবেদ ভাইয়ের অন্তর্দৃষ্টির স্বচ্ছতা আরো একবার বিস্মিত করে।

দায়বদ্ধতা ও প্রাসঙ্গিকতা যদি ব্র্যাকের দুই অবশ্যপালনীয় নীতি হয়, তবে আমার দৃষ্টিতে তৃতীয়টি হচ্ছে, উপযুক্ত ফলাফলের স্পৃহা। স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার যে বোধ আবেদ ভাই সঞ্চারিত করেছিলেন তা কতিপয় ইচ্ছার নিছক ঘোষণা নয়। সকল সৃজনশীল শক্তি ও শ্রম ব্যয় করতে হবে এমনভাবে যার দ্বারা ব্র্যাক যে লাখ লাখ নারী, পুরুষ ও শিশুর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের সকলের জন্য কল্যাণমূলক, পরিমাপযোগ্য এবং টেকসই ফলাফল নিয়ে আসা সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, এর দ্বারা ব্র্যাকের সামর্থ্যও বিকশিত হবে, যা কল্যাণমূলক পরিবর্তন আনতে কার্যকর প্রভাবক হিসেবে সংস্থাটির ভূমিকা ধারাবাহিক ও জোরদার করবে।

লক্ষ্যে অবিচল থাকার বোধকে সঙ্গী করে কাজ করব আমরা। (We have to approach our work with a sense of mission.) আমাদের প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করতে হলে তৃণমূলের কথা আগে শুনতে হবে। কাজের সম্ভাব্য প্রভাব ও ফলাফল বিষয়েও গভীর অনুধাবন থাকতে হবে আমাদের।

২০১৯-এর জুলাইতে আবেদ ভাই আমাকে চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব যখন দিলেন তখন আকাশ থেকে পড়েছিলাম আমি। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী কাজ করতে হবে সে বিষয়ে তাঁর কোনো পরামর্শ আছে কিনা। প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। উত্তর দেননি। এরপর যে কয়েক মাস অফিসে এসেছিলেন একই প্রশ্ন কয়েকবার করেছিলাম তাঁকে। সরাসরি কোনো উত্তর পাইনি। পরে, সংস্থাটির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব তিনি যে গভর্নেন্স ও ব্যবস্থাপনা নেতৃত্বের হাতে অর্পণ করে গেছেন তাঁদের জন্য তাঁর বার্তা কী হতে পারে আমি নিজেই তা ভাবতে চেষ্টা করেছি। যতটুকু বুঝতে পেরেছি, কোনো নম্বর দাগানো দায়িত্বের তালিকার ধারেকাছে ছিল না তাঁর ভাবনা। তিনি আসলে তাঁর আস্থা অর্পণ করে গেছেন উত্তরসূরিদের হাতে। গভর্নেন্স ও ব্যবস্থাপনা নেতৃত্ব এবং সামগ্রিকভাবে সেই প্রতিষ্ঠানটিই হচ্ছে তাঁর উত্তরসূরি। আমাদের দিকে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তিনি। সেই চ্যালেঞ্জ আমরা জিতব যদি যৌথ প্রজ্ঞা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যকর ফলাফল নিশ্চিত করতে পারি ও সঠিক পথ কেটে সামনে এগিয়ে যেতে পারি। তাঁর বৃহত্তর ভাবনাটি ছিল লক্ষ্যের বোধ সঞ্চারিত করাকে কেন্দ্র করে। এই লক্ষ্য তিনি নিজে স্থির করেছিলেন ভোলার ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে, পাঁচ দশক আগে। না বাংলাদেশে, না বিশ্বের অন্যত্র, কোটি কোটি বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের অভিযাত্রা লক্ষ্যের ধারেকাছে নেই কোথাও। অতিমারী-উত্তর বিশ্বে এই বাস্তবতা আরো তীব্র। পেছনে তাকাতে হবে আমাদের। সম্মুখেও।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, ব্র্যাক বাংলাদেশ গভর্নিং বডির চেয়ারপার্সন