‘পদ্মা সেতুর দুই পিলারকে মনে হতো দুটি বাঘ’

কুঞ্জলতা ফেরির চালক সাইফুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

পদ্মা সেতু চালু হয়ে যাওয়ার পর এখন অলস সময় কাটছে কুঞ্জলতা নামের ফেরির চালক সাইফুল ইসলামের। পদ্মা নদী পারাপারের ফেরিঘাট শিমুলিয়া ও বাংলাবাজার পথে আর ফেরি চালাতে হবে না তাঁকে। পবিত্র ঈদুল আজহার পরই হয়তো অন্য কোনো নৌপথে ফেরি চালানোর দায়িত্ব পড়বে তাঁর ওপর।

শিমুলিয়া ৩ নম্বর ফেরিঘাটে গিয়ে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় পাওয়া যায় সাইফুল ইসলামকে। তাঁর ফেরিতেই বসে ছিলেন। ফেরির কর্মীদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। সাইফুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ চলার সময় সেতুর নিচ দিয়ে ফেরি চালাতে ভয় লাগত তাঁর। সেতুর কোনো স্প্যানের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় দুই পাশের দুই পিলারকে মনে হতো দুটি বাঘ।

কেন এই ভয়, তা–ও ব্যাখ্যা করেন সাইফুল। উল্লেখ করেন, ফেরি সেতুর পিলারে ধাক্কা দেওয়ার একাধিক ঘটনার পর তাঁর মনে ভয় ঢুকেছিল। তিনি বলেন, ‘মনে হতো বাঘ দুটি আমাকে খেয়ে ফেলবে। অসম্ভব ভয় নিয়ে ফেরি পারাপার করতাম।’

সাইফুল ইসলামের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সংসার তাঁর। তিনি সাড়ে চার বছরের বেশি সময় ধরে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া-মাদারীপুরে বাংলাবাজার ও শরীয়তপুরের মাঝিরকান্দি নৌপথে ফেরি চালানোর কাজ করেছেন। দায়িত্বের সঙ্গে ফেরিতে করে পারাপার করেছেন দক্ষিণাঞ্চলের জেলার হাজারো যাত্রী ও যানবাহন।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই তাঁর ফেরি চালানো বন্ধ রয়েছে। তবে আসছে কোরবানির ঈদের আগে সেতুতে গাড়ির চাপ বাড়লে আবারও ফেরি চালানো হতে পারে। তাই তিনি এখনো ফেরি নিয়ে শিমুলিয়া ঘাটে বসে আছেন।

এ পথে ফেরি চালানোর নানা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে আমাদের কাজ। এ নৌপথে মানুষ ও যানবাহন পারাপারে সব সময় ব্যস্ত থাকতাম। আজ কদিন হলো, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে। ঘাটে আর যানবাহন আসে না। পদ্মায়ও দেখা দিয়েছে নাব্যতা–সংকট। এ জন্য ফেরি চালানো বন্ধ রয়েছে। ঘাটে বসে অলস সময় পার করছি। ঘাটে মানুষের হাঁকডাক নেই। তাই কিছুটা খারাপ লাগছে।’

প্রচণ্ড স্রোত, নাব্যতা–সংকট, ঘনকুয়াশা, উত্তাল ঢেউ, বৈরী আবহাওয়াসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে অনেক সময় ফেরি চালানো বন্ধ থাকত। লাশ, অসুস্থ রোগী নিয়ে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে অপেক্ষা করত। ঈদযাত্রায় কত শত ভোগান্তি ছিল যাত্রী ও যানবাহনচালকদের। তাদের সময়মতো পার করতে না পারায় তাঁর অনেক খারাপ লাগত। তখন ভাবতেন, এই মানুষগুলোকে যদি সময়মতো পদ্মা পাড়ি দেওয়াতে পারতেন!

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এই নৌপথে ফেরি বন্ধ হলে আমরা অন্য নৌপথে চলে যাব। এমন কোলাহলপূর্ণ নৌপথ আর হয়তো পাব না। ফেরি চালাতে গিয়ে কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়েছে। অনেকের সঙ্গে এখনো ফোনে কথা হয়। এসব মানুষ হয়তো আর কখনো ফেরিতে আসবে না। তাদের অনেক মিস করব।’

সাইফুলের মতো করেই স্মৃতিচারণা করছিলেন কুঞ্জলতার পাশে নোঙর করা ফেরি কেমেলিয়ার হুইল সুকানি মো. রাশেদুল ইসলাম। নৌপথের চাকরিজীবন এ ঘাট দিয়ে শুরু তাঁর। ২০১১-১৪ সাল পর্যন্ত এ নৌপথে কাজ করেন তিনি। মাঝখানে ২০১৪-১৮ সাল পর্যন্ত চাকরির সুবাদে চাঁদপুরে ছিলেন। পরে আবারও এ নৌপথেই ফিরে আসেন তিনি।

ফেরি চলে না, ঘাটে অলস বসে আছে ফেরিগুলো। শুক্রবার বিকেলে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

রাশেদুল ইসলাম বলেন, এ নৌপথ আমার জীবনের একটা অংশ। স্মৃতির বেশির ভাগটাজুড়ে এ ঘাট। তিনি বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে সব ধরনের যানবাহন বন্ধ ছিল। দক্ষিণ অঞ্চলে জেলাগুলোর মানুষ তাদের বাড়িতে ফেরার জন্য কী পরিমাণ কষ্ট করেছে, তা আমি নিজ চোখে দেখেছি। যখনই আমরা ঘাটে ফেরি বেড়াতাম, মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ত। একটা গাড়ি পর্যন্ত ফেরিতে নিতে পারতাম না। এমনভাবে মানুষের স্রোত আসত। তাদের কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। তারপরও আমরা বিরক্ত হতাম না। মানুষকে আমরা ফেরিতে নিতাম। অনেক সময় দেখতাম ফেরিতে বাচ্চাকে উঠিয়ে মা উঠতে পারছে না। আবার কখনো মা উঠেছে বাচ্চা উঠতে পারেনি। আমরা তাদের ওঠাতাম। তাদের পদ্মা নদী পার করতাম। তখন মানুষের মুখে যে হাসিটা দেখতাম, সেটা বর্ণনা করার মতো না। জীবনটা সার্থক মনে হতো।’

রাশেদুল আরও বলেন, ‘অনেকবার পদ্মা পাড়ি দেওয়ার সময় ঝড়ের কবলে পড়তে হয়েছে। ঝড় ও খরস্রোতের টানে ফেরি, স্পিডবোট, ড্রেজারের পাইপ ও লঞ্চের মুখোমুখি হয়েছি। তখন ভেতরে কিছুটা ভয় কাজ করত। এতগুলো মানুষ ও যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে থাকত। একটু এদিক-ওদিক হলেই বিপর্যয় নেমে আসবে। সব সংকট কাটিয়ে তাদের নিরাপদে যখন পৌঁছে দিতাম, তখন মনে হতো, নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি।’

রাশেদুল জানান, পদ্মা সেতুতে সব কটি স্প্যান উঠে যাওয়ার পর কয়েকবার ফেরি সেতুর খুঁটিতে ধাক্কা দেয়। তখন সেতুর নিচ দিয়ে ফেরি চালাতে গিয়ে ভেতরে অনেক বেশি ভয় কাজ করত। হাত-পা কাঁপাকাঁপি করত।

বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের উপমহাব্যবস্থাপক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এ ঘাটে ফেরি কুঞ্জলতা, কুমিল্লা, কেমেলিয়া, ফরিদপুরসহ সাতটি ফেরি রয়েছে। ঈদুল আজহার সময় যানবাহনের চাপ বাড়লে এ ঘাট দিয়ে ফেরি চলাচল করার সম্ভাবনা রয়েছে।

শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এরপর ফেরি চলবে কি না, ঠিক তা জানা নেই। এ ঘাটে আমি দুই বছর ছিলাম। দেশের অন্যান্য ঘাটের তুলনায় এ ঘাটে কাজের অনেক চাপ ছিল। তবে সবার সহযোগিতা ছিল অনেক বেশি। এ কারণে সব কঠিন কাজগুলো সহজেই করতে পেরেছি। এ ঘাটে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর চেয়ে বেশি মধুর অভিজ্ঞতা আছে। যদি ঘাট বন্ধ হয়ে যায়, এখান থেকে কখনো চলে যেতে হয়, এ ঘাটের কথা সব সময় মনে থাকবে।’