পরিবারের সচেতনতা জরুরি

গার্লস নট ব্রাইডসের উদ্যোগে আয়োজিত সংলাপে অংশ নেওয়া কয়েকজন।

বাল্যবিবাহ রোধের ক্ষেত্রে শুধু আইনের প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে পারিবারিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতাসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে বাল্যবিবাহ রোধে একযোগে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোগী হতে হবে। একই সঙ্গে পুরুষদের মানসিকতারও পরিবর্তন দরকার। বাল্যবিবাহ শিশুর ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে, এই বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। ‘শুধু আইন কি বাল্যবিয়ে রোধে যথেষ্ট?’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সংলাপে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে।

গার্লস নট ব্রাইডসের উদ্যোগে এই সংলাপ আয়োজনে সহযোগিতা করে উন্নয়ন সংস্থা পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, ওয়ার্ল্ড ভিশন ও টেরে ডেস হোমস নেদারল্যান্ডস। সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রচার করা হয়।

বাল্যবিবাহ রোধে সরকারের পাশাপাশি যেসব বেসরকারি সংস্থা কাজ করে, তাদেরসহ সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন। তিনি বলেন, সবাই নিজ জায়গা থেকে কাজ করলে বাল্যবিবাহ কমে আসবে। তিনি সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের কথাও সংলাপে তুলে ধরেন। তাঁর মতে, আইনের চেয়ে শিশুদের ভবিষ্যতের বিষয়গুলো বেশি প্রচার করতে হবে। পরিবার যখন বুঝতে পারবে যে তারা যেভাবে শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে, তা আলোকিত না অন্ধকার, তখন হয়তো তারা সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত। মেয়েদের সাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। পরিবারে যদি মেয়েরা উপার্জনের মাধ্যমে অবদান রাখতে পারে, তাহলে নিজেদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন হবে।

সংলাপে বান্দরবান জেলার পুলিশ সুপার জেরিন আখতার বলেন, ‘মা–বাবা কেন বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে চাচ্ছে না, পরিবার কেন বুঝছে না যে এটা সন্তানের জন্য ভালো নয়। আইনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারগুলোর মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয়গুলো দেখতে হবে। শুধু আইন দিয়ে এই সামাজিক সমস্যাকে রোধ করা কঠিন।’

করোনাভাইরাসের এই সময়ে বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে উল্লেখ করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গার্লস রাইটস পরিচালক কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, এ সময়ে অনেক প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। অনেক মা–বাবা ফেরত আসা প্রবাসীদের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।

করোনার মধ্যে বাল্যবিবাহ বেড়েছে। অনেক পরিবার গোপনে মেয়ে বিয়ে দিয়েছে।
সাবুল চন্দ্র সরকার, দিনাজপুরের ধর্মপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান

বাল্যবিবাহ নারী ক্ষমতায়নের প্রধান বাধা বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম। তিনি বলেন, ভুয়া জন্মনিবন্ধন দিয়ে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা রয়েছে। জন্মনিবন্ধনপত্র জনপ্রতিনিধিরাই দিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

বাল্যবিবাহ রোধে আইনের প্রয়োগ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলীমা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, এসব দেখতে হবে। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে মেয়ে–ছেলেদের বয়স নির্ধারণ নিয়ে কোনো বৈষম্য হচ্ছে কি না, তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।

পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (পিএসটিসি) ‘হ্যালো আই এম প্রোগ্রাম’–এর প্রধান সুস্মিতা আহমেদ নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, বাল্যবিবাহ যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তা এখনো অনেকে জানে না। বাল্যবিবাহ রোধে পরিবার থেকে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তার কারণে অনেক পরিবার বাল্যবিবাহ দিচ্ছে জানিয়ে তিনি মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার বিষয়টিও তুলে ধরেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি আইনের প্রয়োগ চান। এ ছাড়া বাল্যবিবাহে সাজার পরিমাণ কম বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

ভুয়া জন্মনিবন্ধন দিয়ে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা রয়েছে। জন্মনিবন্ধনপত্র জনপ্রতিনিধিরাই দিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
সীমা মোসলেম, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার বলেন, বাল্যবিবাহের ফলে একজন মেয়ে শুধু শারীরিকভাবেই নির্যাতিত হয় না মানসিকভাবেও নির্যাতনের শিকার হয়।
বাল্যবিবাহ রোধে স্থানীয়ভাবে ধর্মীয় নেতা ও পুরুষদের সম্পৃক্ত করলে সুফল পাওয়া যায় বলে জানান ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের ইন্টিগ্রেটেড থিমেটিক সলিউশন পরিচালক বুলি হাগিদক। তিনি বলেন, ধর্মীয় নেতাদের মানুষ অনেক গুরুত্ব দেয়। তাদের কথা শোনে। তাদের সম্পৃক্ত করলে কাজে দেয়। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। পুরুষদেরও যদি মানসিকতার পরিবর্তন করা যায়, তাহলে তার প্রভাব সমাজে পড়ে।

বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির পরিচালক (প্রোগ্রাম) সঞ্জীব আহমেদ বলেন, স্কুলে এখনো যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে ভালোভাবে পড়ানো হয় না। এটা নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না। এ বিষয়কে স্কুলে গুরুত্ব দিয়ে পাড়নো এবং এসব বিষয় পরীক্ষায় আসা দরকার বলে মনে করেন। আইন করে বাল্যবিবাহ রোধ করা যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা এবং তরুণদের সচেতন করতে হবে।

সংলাপে দিনাজপুরের ধর্মপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবুল চন্দ্র সরকার তাঁর এলাকায় বাল্যবিবাহ বন্ধ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, করোনার মধ্যে বাল্যবিবাহ বেড়েছে। অনেক পরিবার গোপনে মেয়ে বিয়ে দিয়েছে। তিনি আইনের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলেন।

ভার্চুয়্যাল সংলাপে আরও বক্তব্য দেন বেসরকারি সংগঠন আভাসের পরিচালক রহিমা সুলতানা এবং টেরে ডেস হোমস নেদারল্যান্ডসের চেঞ্জমেকার বিউটি খাতুন।