পরিবারে চাই 'প্রিয় বাবা'

‘প্রিয় বাবা’ কর্মসূচির প্রচারণা বৈঠকের ছবিটি সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নগরবন্দ গ্রাম থেকে তোলা l প্রথম আলো
‘প্রিয় বাবা’ কর্মসূচির প্রচারণা বৈঠকের ছবিটি সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নগরবন্দ গ্রাম থেকে তোলা l প্রথম আলো

পাবনার ফরিদপুর উপজেলার আগপুংগলি গ্রামে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য নুরুল ইসলামের ছেলের বউ শাপলা রানি। নিজের পছন্দের বিয়েতে ধর্মের বিষয়টি তেমন একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বলে জানালেন শাপলা।
গত সোমবার ঢাকা থেকে টেলিফোনে কথা হয় শাপলার সঙ্গে। তিনি এখন মোটরসাইকেলে করেই কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফেরেন। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমার শ্বশুর বা সরকারি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত স্বামী কোনো কাজে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেননি। শাশুড়িও শৌখিন মানুষ। মোটরসাইকেল চালাই, তা নিয়ে গ্রামে কয়েকজন খারাপ কথা বললেও খুব একটা গায়ে মাখিনি। মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবারের, বিশেষ করে শ্বশুর ও অন্যদের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
শাপলা রানি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আগপুংগলি গ্রাম থেকে সেখানকার দূরত্ব পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার। রাজশাহী কলেজ থেকে এমএ পাস করা ছেলের বউয়ের যাতায়াতে কষ্ট হয়। এর আগে গর্ভধারণের আট মাসের সময় একটি সন্তানও নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে নুরুল ইসলামই একটি মোটরসাইকেল কেনার জন্য অনুপ্রেরণা দেন শাপলাকে।
এলাকায় নুরুল ইসলাম একজন সফল স্বামী। দুই ছেলের সফল বাবা ও এক ছেলের বউয়ের কাছে সফল শ্বশুর হিসেবে পরিচিত। তিনি বাবাদের রোল মডেল। তিনি এখন এলাকার অন্য বাবাদের ‘প্রিয় বাবা’ হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।
গবেষণা সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের প্রোমাউন্ডো-ইউএস এবং বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত গবেষণাবিষয়ক এনজিও সেন্টার ফর ম্যান অ্যান্ড ম্যাসকিউলিনিটি স্টাডিজ (সিএমএমএস) যৌথভাবে ‘প্রিয় বাবা’ নামের ক্যাম্পেইন বা প্রচারের আওতায় নুরুল ইসলামের মতো মোট ৬০ জন সফল বাবাকে খুঁজে বের করেছে। বর্তমানে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, নাটোর ও কক্সবাজারে গবেষণার অংশ হিসেবে ১ হাজার ১০০ জন বাবাকে প্রিয় বাবা হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী সন্তানের বাবাদের প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি মডিউলের আওতায় বাবাদের পিতৃত্ব, ছেলেমেয়ের সমান অধিকার, দৈনন্দিন কাজে স্বামী-স্ত্রীর সমান অংশগ্রহণ, দাম্পত্য সম্পর্ক কীভাবে সন্তানের জীবনে প্রভাব ফেলে, গর্ভাবস্থায় নারীর স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে স্বামী-স্ত্রীর সমান অংশগ্রহণ, মাদকের কুফল নিয়ে সচেতন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক সংগঠন ইউভিএস ফাউন্ডেশন।
আসলেই কি বাবাদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটছে, যা পরিবারের নির্যাতন প্রতিরোধে ভূমিকা রাখছে? সিরাজগঞ্জে এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা আমজাদ অনেকটা অকপটেই বললেন, ‘আগে এত কিছু চিন্তা করি নাই। স্ত্রীকে আগে একটু-আধটু চড়থাপ্পড়ও দিতাম। সেও যে বাড়িতে অনেক পদের কাজ করে, তা আগে সেভাবে বুঝতাম না। এখন অনেক কিছু বুঝতাছি।’ আমজাদ কৃষিকাজ করেন। তাঁর স্ত্রী শাহিদা খাতুনও স্বামীর কথায় সায় দিয়ে জানালেন, স্বামী এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আচরণ করেন।
‘প্রিয় বাবা’ ক্যাম্পেইনে কী শিখেছেন, জানতে চাইলে আমজাদ তাঁর শেখা একটি গল্পের কথা জানালেন। গল্পে এক বাবা সন্তানকে সব সময় দূর দূর করেন। সংসারের কাজে তিনি কখনোই কোনো সহায়তা করেন না। গল্পের শেষে গিয়ে ওই বাবা নিজের ভুল বুঝতে পারেন। আপনিও কি সন্তানদের দূর দূর করতেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে লাজুক হেসে আমজাদ ‘হ্যাঁ’ জানালেন। তবে পরমুহূর্তেই জানালেন, এখন সন্তানদের সময় দেওয়ার চেষ্টা করেন।
‘প্রিয় বাবা’ ক্যাম্পেইন প্রসঙ্গে সিএমএমএসের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, বিরূপ পরিস্থিতিতে যে বাবা মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন না, স্ত্রীকে নির্যাতন করেন না, তাঁদের সামনে এনে অন্যদের সচেতন করা যায় কি না, তার জন্য ২০১১ সালে পাঁচটি গ্রামে সফল বাবাদের খোঁজা শুরু হয়। ২০১৩ সাল থেকে ফলিত গবেষণার জন্য স্থানীয় এনজিও সহায়তায় কাজ চলছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হবে। ফলাফল ইতিবাচক হলে তা ব্র্যাকসহ অন্যান্য এনজিওর কাছে তুলে ধরা হবে।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় ‘প্রিয় বাবা’ ক্যাম্পেইনের সমন্বয়কারী গোলামে-জুল জালাল প্রথম আলোকে বলেন, ইরি ধান কাটার মৌসুমে এলাকার অনেকেই অন্য জেলায় গিয়ে কাজ করেন। এ ছাড়া পুরুষদের কাজ মূলত মাঠঘাটে। তাই তাঁদের জন্য সন্ধ্যার পর বৈঠকের আয়োজন করতে হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বাবাদের দেওয়া হয় হালকা নাশতা। পড়াশোনার দিক থেকে সর্বোচ্চ এইচএসসি পাস বাবা আছেন। এলাকার আটটি গ্রামে সাতটি ইউনিটে (প্রতি ইউনিটে ২০ জন করে বাবা) কাজ চলছে।
গোলামে-জুল জালালের মতে, শতভাগ বাবার মধ্যে পরিবর্তন ঘটে গেছে, তা বলা যাবে না। তবে আগে যে যে কাজগুলো করতেন, তা ভুল ছিল বা গতানুগতিকতার বাইরে চিন্তা করতে শিখছেন তাঁরা।
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার আগপুংগলি পরিচালিত এ গবেষণার কাজে বাবাদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন ৫০ বছর বয়সী সাইফুল ইসলাম। এলাকায় মোট ১১০ জন বাবাকে নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। তাঁর মতে, প্রকল্পের সুফল খুব দ্রুতগতিতে বোঝা সম্ভব হবে না। বর্তমানে যেসব শিশুর বাবাদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, ওই শিশুরা ভবিষ্যতে সুস্থ মস্তিষ্কের নাগরিকে পরিণত হবে। এসব পরিবারের নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরুষ হিসেবে স্বামী বা বাবার অযথা হম্বিতম্বি কমেছে। অনেকে খানিকটা মাথা গরম করে ফেললে পরিবারের নারীরা প্রশিক্ষকদের কথা কৌশলে মনে করিয়ে দেন। তাতেও বেশ কাজ হয়।