পরীর পাহাড় ও আশাবাদ

বর্তমানে এখানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, নতুন আদালত ভবন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন, আইনজীবীদের পাঁচটি ভবনসহ বেশ কিছু সরকারি কার্যালয় আছে। এ ছাড়াও এর চারপাশে অপরিকল্পিত ও অনুমোদনহীন বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এটি যেন বড় কোনো ব্যস্ত বাজার
ছবি: প্রথম আলো

পরীর পাহাড়ে নতুন দুটি ভবন নির্মাণ নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি ও জেলা প্রশাসনের দ্বন্দ্বের মধ্যে শেষ পর্যন্ত সরকারের অবস্থান এবং সিদ্ধান্তে চট্টগ্রামের সচেতন, ঐতিহ্যপ্রিয় ও পরিবেশবাদী মানুষের মনে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। তাদের মনে আশাও জেগেছে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, পরীর পাহাড়ে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ না করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। খবরে জানা যায়, এখানে যাতে আর কোনো স্থাপনা না হয়, সে বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ১৩ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলোকে।

আইনজীবী সমিতি পরীর পাহাড়ে নতুন করে দুটি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর দ্বন্দ্বটা শুরু হয়। সমিতির এ উদ্যোগের ব্যাপারে অবহিত হয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন ২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় পত্রপত্রিকায় একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ‘দেশের প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান অমান্য করে পরীর পাহাড় এলাকায় কোনো ধরনের পরিবেশ বিধ্বংসী দখলবাজি, খাস জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ এবং স্থাপনা নির্মাণ কাজে সহযোগিতা প্রদান দণ্ডনীয় অপরাধ এবং এহেন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হলো।’

প্রশাসনের এই বিজ্ঞপ্তির পরও আইনজীবী সমিতি তাদের নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি। ৮ সেপ্টেম্বর জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সভায় বরং পরীর পাহাড় থেকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অন্য কোথায় সরিয়ে নিতে দাবি উত্থাপন করা হয়। সভায় বলা হয়, আইনজীবীদের তীব্র চেম্বার সংকট নিরসন করতে প্রস্তাবিত দুটি ভবনের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। সভায় বক্তারা বলেন, যে এলাকায় আদালত চলে, সে এলাকায় আইনজীবী থাকবেন আইনজীবী ভবনও থাকবে।

জেলা প্রশাসন বলেছে, পাহাড়ে নতুন ভবন নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ হবে আর ভবন নির্মাণের কোনো অনুমোদন নেই। অন্যদিকে সমিতি বলেছে, তারা যথাযথ নিয়ম মেনে অনুমতি নিয়ে ভবন তৈরি করছে। নগরের এই বিখ্যাত পাহাড়ের চূড়ায় একসময় ছিল চাকমা রাজার ভবন। সেখানে বসত গানের আসর। তা নিয়ে নানা উপকথাও তৈরি হয় লোকমুখে। স্থানীয় লোকজন বলতেন, সেই পাহাড়চূড়ায় পরিরা গান গায়, নেচে বেড়ায়। এমন কাহিনির সূত্র ধরে পাহাড়টির নাম হয়েছিল পরীর পাহাড়। ইংরেজ সাহেবদের কাছে ফেয়ারি হিল নামে পরিচিত এই পাহাড় ইংরেজ আমলেই চট্টগ্রাম বিভাগ ও জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল।

বর্তমানে এখানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, নতুন আদালত ভবন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন, আইনজীবীদের পাঁচটি ভবনসহ বেশ কিছু সরকারি কার্যালয় আছে
ছবি: প্রথম আলো

এখানকার আদালত ভবনটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কিন্তু কালে কালে সংকুচিত হয়ে পড়েছে পরীর পাহাড়। পরীর পাহাড়ের পশ্চিম-উত্তরাংশের নাম ছিল টেম্পেস্ট হিল। ইংরেজ আমলে এই পাহাড়ের মালিক ছিলেন হ্যারি নামের এক পতু‌র্গিজ। পরে পাকিস্তান সরকার এটিকে হুকুম দখল করে কালেক্টরের বাসভবন নির্মাণ করে। বর্তমানে কালেক্টরের বাসভবনসহ গোটা টেম্পেস্ট হিলটাই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। টেম্পেস্ট হিলের পূর্বে ও পরীর পাহাড়ের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি অনুচ্চ পাহাড়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের অফিস ও বাংলো ছিল। এটিও কেবল নামেই আছে।

সেই সব হারিয়ে যাওয়া পাহাড়ের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ইটপাথরের জঞ্জালের ভেতর কোনোরকমে টিকে আছে পরীর পাহাড়। এখানে আদালত ভবনের কার্যক্রম শুরু হয় প্রায় ১৩০ বছর আগে। বর্তমানে এখানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, নতুন আদালত ভবন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন, আইনজীবীদের পাঁচটি ভবনসহ বেশ কিছু সরকারি কার্যালয় আছে। এগুলো ছাড়াও এর চারপাশে অপরিকল্পিত ও অনুমোদনহীন বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম আদালত ভবন মানে মানুষের ভিড়, রাস্তার দুই পাশের যেখানে–সেখানে গাড়ি পার্কিং, বিভিন্ন দোকানপাট, খাবার হোটেল, কম্পিউটার দোকান, এমনকি কাঁচাবাজার ও শুঁটকির দোকান পর্যন্ত পাওয়া যায়। এটি যেন বড় কোনো ব্যস্ত বাজার। এমন কোলাহল আর অনিয়মে গড়ে ওঠা নানা স্থাপনার ভেতর পাহাড়ের সৌন্দর্য রক্ষা কিংবা আদালত ভবনের প্রাচীন স্থাপত্য চিহ্নের মর্যাদা রক্ষা করা কঠিন।

ঠিক এই অবস্থায় বহু আইনজীবীর জন্য ভবনের নির্মাণের প্রয়োজনের বিপক্ষে জেলা প্রশাসনের ঐতিহ্য পরিবেশ রক্ষার তাগিদে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে হয়েছে, তা নতুন কিছু নয়। চট্টগ্রাম নগরের জন্য তা বহু পুরোনো। প্রয়োজনের কারণে এই পার্বত্য নগরের পাহাড়গুলো কেটে কেটে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ভূমি জরিপের খতিয়ানে এমন সব পাহাড়ের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে, যা এখন আর নেই। নগরের ইতিহাস-সম্পর্কিত বিভিন্ন বইতেও বহু পাহাড়ের উল্লেখ রয়েছে। কোনোটিতে ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দালানকোঠা, কোনোটির সঙ্গে যোগ ছিল ইতিহাসের নানা ঘটনা। গত শতাব্দীর ব্যবধানে চট্টগ্রামের বেশির ভাগ পাহাড় অস্তিত্ব হারিয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের শুরু থেকে এযাবৎ কত পাহাড় বিলীন হয়েছে, তার কোনো হিসাব কোথাও পাওয়া যায় না। আশির দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম শহরে ২৩০টি পাহাড়ের চূড়া চিহ্নিত করা হয়েছিল। এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে অর্ধশতের কম পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়।

চট্টগ্রাম নগরের শুরু থেকে এযাবৎ কত পাহাড় বিলীন হয়েছে, তার কোনো হিসাব কোথাও পাওয়া যায় না
ছবি: প্রথম আলো

আর আছে কিছু বিচ্ছিন্ন, কর্তিত চূড়াবিহীন পাহাড়। প্রতিদিন সূর্য ওঠার মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে পাহাড় কাটা। সরকারি দপ্তর, সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজনীতিবিদ, প্রতিষ্ঠিত শিল্পগ্রুপ—সবাই মিলে পাহাড় সাবাড় করছে। তার প্রমাণ সরকারি দপ্তরেই আছে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে শুধু খুলশী এলাকায় পাহাড় কাটার দায়ে ছয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। খোদ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকেও পাহাড় কাটার দায়ে জরিমানা দিতে হয়েছে বড় অঙ্কের টাকা। পাহাড় কাটা যেন চট্টগ্রামে এক দুরারোগ্য সংক্রামক ব্যাধির মতো। যতই জরিমানা আর সাজা হোক, এই কাটা রোধ করা যাচ্ছে না।

পাহাড় কাটা কিংবা পাহাড় দখলের এই চরম নৈরাজ্যের দিনে পরীর পাহাড়কে ঝুঁকিমুক্ত করতে সরকারের এই অবস্থানের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, পরীর পাহাড়ে অবৈধ স্থাপনাগুলোর তালিকা করবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। সেই তালিকা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন উচ্ছেদের ব্যাপারে নোটিশ প্রদান করবে।

সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে আইনজীবীদের চেম্বার সংকট নিরসনের উদ্যোগ ঝামেলার মধ্যে পড়লেও ভবিষ্যতে পাহাড়, কিংবা উঁচু টিলা রক্ষায় এই সিদ্ধান্ত একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে অনেকেই মনে করছেন। তবে আদালত ভবনে বিচারপ্রত্যাশী প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে। তাঁদের সঙ্গে আইনজীবীদের সংযোগস্থল আইনজীবী ভবনের সমস্যা নিরসনের ব্যাপারটাও সরকারের মাথায় রাখা বাঞ্ছনীয়। পাহাড়ের কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে অথবা সরকারি অন্য কোনো খাস জায়গায় আইনজীবীদের নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

পরীর পাহাড়ের সৌন্দর্য, পরিবেশ, ঐতিহ্য রক্ষায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন ও সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে আইনজীবীদের অসুবিধা সত্ত্বেও জনগণ কিছুটা আশার আলো দেখছেন সিআরবি নিয়ে। সিআরবির সবুজ, ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রত্নসম্পদ, ঐতিহ্য রক্ষার জন্য যাঁরা সরব, তাঁদের আশা, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিআরবির ব্যাপারেও অচিরেই এক জনবান্ধব, পরিবেশবান্ধব একটি সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। মানুষের এই প্রত্যাশা একেবারেই অলীক কিছু নয়।