পাকিস্তান শাসকদের চরিত্র পাল্টায়নি, বললেন বালুচ নেতা

বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মীর সুলেমান দাউদ জান আহমেদজাই।ছবি: প্রথম আলো
বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মীর সুলেমান দাউদ জান আহমেদজাই।ছবি: প্রথম আলো

পাকিস্তানের শাসকদের চরিত্র পাল্টায়নি। ওরা দীর্ঘ সময় বাঙালিদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। বেলুচিস্তানের মানুষের ওপর তাদের নিপীড়ন এখনো চলছে। স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন চান বালুচরা। কথাগুলো বললেন পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মীর সুলেমান দাউদ জান আহমেদজাইয়ের (৫২)। তিনি ‘খান অব কালাত’ নামে সুপরিচিত।
আজ বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে মীর সুলেমান দাউদ জান আহমেদজাই এবং বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী অপর নেতা মুনির মেঙ্গেলের সঙ্গে কথা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের আমন্ত্রণে একটি সেমিনারে যোগ দিতে গতকাল মঙ্গলবার তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁদের এই সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য, বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার লড়াইকে এ দেশের মানুষকে জানানো। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনও চান তাঁরা।
বেলুচিস্তানের রাজন্যশাসিত এলাকা খানাতে অব কালাতের শাসক এই পরিবার। পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতে চায়নি কালাতের মানুষ। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জোর করে কালাতকে একীভূত করে নেয় বলে জানান ‘খান অব কালাত’।
ঐতিহ্যবাহী বালুচ টুপি, বুকপকেটে লাল-সবুজের বালুচ পতাকার অংশ আর কালো রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি পরা খান অব কালাত এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শোনালের বেলুচিস্তানের ইতিহাস, তাঁদের কৃষ্টি, সেখান চলা নিপীড়ন এবং স্বাধীনতার জন্য তাঁদের অদম্য লড়াইয়ের কথা। মীর সুলেমান দাউদ জান আহমেদজাই বললেন, বেলুচিস্তান ও বাংলাদেশ দুটিই ইংরেজি শব্দ ‘বি’ দিয়ে শুরু। বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত পতাকার মধ্যেও মিল আছে। তিনি এও বললেন, ‘আরও মিল আছে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে দুই অঞ্চলের মানুষের নিপীড়িত হওয়ার ইতিহাসে। বাংলাদেশের মানুষের সৌভাগ্য যে তারা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়ে স্বাধীন হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার লড়াই আজও চলছে।’

বেলুচিস্তান তথা কালাতের স্বাধীনতা হরণের ইতিহাস শোনান লন্ডনপ্রবাসী এই নেতা। তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট ‘খান অব কালাত’ মীর আহমেদ ইয়ার খান আহমেদজাই বালুচ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৪৮ সালের মার্চে সেই স্বাধীনতার অবসান হয় পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্রাসনে। এরপর থেকেই সেখানে চলছে মুক্তিকামী মানুষের লড়াই। এখনও বেলুচিস্তানে প্রতিদিন অগ্নিসংযোগ, গুম, হত্যা, ধর্ষণ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব ভয়াবহ নিপীড়ন আপনাদের ওপর চলেছে, এখন তা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।’

এ পর্যন্ত ২৫ হাজারের বেশি তরুণ বালুচ নিখোঁজ বলে অভিযোগ করেন খান অব কালাত। স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলায় এসব তরুণ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর রোষানলে পড়েছে।

২০০৬ সালে বেলুচিস্তান ছেড়ে লন্ডনে চলে যান খান অব কালাত। কেন এই পলায়ন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি পালিয়ে আসিনি। আমি বালুচ জিরগা (সব গোষ্ঠী নেতাদের বৈঠক) আহ্বান করেছিলাম। আমি বেলুচিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এসব বিষয়ের জন্য সেখানে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। এখন আমি মুক্তভাবে কাজ করতে পারছি।’

বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের নানান বর্ণনা দেন মীর সুলেমান দাউদ জান আহমেদজাই। তিনি বলেন, পাকিস্তানে দুটি ‘জঙ্গিগোষ্ঠী’ আছে। একটি সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া দেশটির সামরিক বাহিনী এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। অন্যটি হাক্কানি নেটওয়ার্ক, লস্কর-ই-তাইয়েবার মতো উর্দিহীন জঙ্গিগোষ্ঠী। এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে সহায়তা করে। ‘খান অব কালাত’ বলেন, বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে পাকিস্তান। ম্যানিলা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া—যেখানেই সন্ত্রাস হোক, সেখানে পাকিস্তানের সহযোগিতা আছে।

বেলুচিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে ভারত। পাকিস্তান অভিযোগ করেছে, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের চলমান আন্দোলন ঠেকাতেই বালুচদের সমর্থন দেয় ভারত। এ ব্যাপারে বালুচ এই নেতা বললেন, ‘আমি যখনই কোনো পাকিস্তানি সাংবাদিকের মুখোমুখি হই, শুরুতেই তাঁরা বলেন, কাশ্মীরে মুসলিমদের অবস্থা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? আমি তখন বলি, যখন আমার বাড়ি পুড়ছে, আমার মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন আপনারা সে বিষয় নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না কেন?’

১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে দুইবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখার সুযোগ হয়েছিল বলে জানান খান অব কালাত। তিনি বললেন, ‘তখন সাত-আট বছর বয়স ছিল। কোন কথা হয়েছিল বলে মনে নেই। পরে এই মহান মানুষটির ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছি, সেই মানুষটিকে দেখেছিলাম আমি।’
বঙ্গবন্ধুর মতো বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন কালাত। আর এই আশা আছে তাঁর বুকে, নিরাশ হন না তিনি।