পাটের ব্যাকটেরিয়ায় সম্ভাবনার খোঁজ

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া থেকে নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছেন, যা হতে পারে চিকিৎসাশাস্ত্রের বড় সাফল্য।

পাটের জীবনরহস্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে পাওয়া গেছে নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক।
ফাইল ছবি

পাটের জীবনরহস্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উন্মোচন করেছেন নতুন একটি সম্ভাবনার দ্বার। তাঁরা পাটে (এন্ডোফাইটে) নতুন একটি ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন, যা দিয়ে মানুষের জন্য নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা সম্ভব হতে পারে।

নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের নাম দেওয়া হয়েছে ‘হোমিকরসিন’। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর গঠন এতটাই জটিল যে অন্য ক্ষতিকর অণুজীবগুলো এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে না। তবে এটি থেকে মানব শরীরে প্রয়োগের উপযোগী ওষুধ তৈরি করতে আরও গবেষণা দরকার।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে এখন যত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বাজারে রয়েছে, সেগুলোর বিপরীতে ‘রেজিস্ট্যান্স’ বা প্রতিরোধক্ষমতা

অধ্যাপক হাসিনা খান, অধ্যাপক আফতাব উদ্দিন ও অধ্যাপক মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম

প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। ফলে অনেকের শরীরে পুরোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। উল্লেখ্য, অ্যান্টিবায়োটিক হলো এমন একটা উপাদান, যা ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস থেকে সংগ্রহ করে অন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসকে ধ্বংস কিংবা তার বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়।

ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পাওয়ার এই গবেষণা যৌথভাবে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) বিজ্ঞানীরা। গবেষক দলের নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক হাসিনা খান, যিনি বর্তমানে ইউজিসি অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দলে আরও রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম এবং জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক মো. আফতাব উদ্দিন। গবেষণার কাজে বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানী এ এইচ এম শফিকুল ইসলাম মোল্লা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাম্মী আক্তার, মাহবুবা ফেরদৌস, বদরুল হায়দার ও আল–আমিন যুক্ত রয়েছেন।

এই গবেষণায় পরামর্শ দিয়ে এবং অন্যান্যভাবে সহায়তা করেছেন জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব বনের অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েলে বিয়রবাম, কিয়ুশু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকেশি জেন্ডো এবং টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজুইশা সেকিমিজু।

গবেষণাটির ওপর ভিত্তি করে একটি নিবন্ধ গত ২৭ মে বিশ্বখ্যাত নেচার পাবলিশিং গ্রুপের সায়েন্টিফিক রিপোর্ট বৈজ্ঞানিক মেগা জার্নালে প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পাটের মধ্যে থাকা অণুজীব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ‘স্টেফাইলোকক্কাস হোমিনিস’ নামে একটি নতুন ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। পাটের মধ্যেই বসবাস করে এটি। এই ব্যাকটেরিয়া চমৎকার একটি অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে, যা অন্য ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে।

এই অধ্যাপক আরও বলেন, সর্বশেষ আবিষ্কৃত হওয়া অ্যান্টিবায়োটিক হচ্ছে কার্বোপিনাম, যেটিকে গবেষকেরা সর্বশেষ ভরসা হিসেবে চিন্তা করেছিলেন। সেটির বিরুদ্ধেও ক্ষতিকর অণুজীবগুলো সহিষ্ণুতা (রেজিস্ট্যান্স) তৈরি করে ফেলেছে। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনের গবেষণায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, এমন এক সময়ে নতুন এই অ্যান্টিবায়োটিক প্রস্তুত করা গেলে তা চিকিৎসাশাস্ত্রে অভূতপূর্ব অবদান রাখতে পারবে। সে লক্ষ্যেই কাজ চলছে।

শুরু যেভাবে

২০০০ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান পাট নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনিই এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১৪ সালে সরকারের একটি প্রকল্পের অধীনে পাটে থাকা অণুজীব চিহ্নিত ও শ্রেণিবিন্যাস করার কাজ শুরু হয়। তখন শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে চলত পাটের জিন–নকশা নিয়ে কাজ।

অধ্যাপক হাসিনা খান জানান, তিনি গবেষণাকালে একটি নতুন ডিএনএ বিন্যাস খেয়াল করেন। শুরুতে তিনি মনে করেছিলেন, শিক্ষার্থীরা হয়তো কাজ করার সময় ভুল করে অণুজীবের দূষণ (কন্টামিনেশন) করছেন। দীর্ঘ গবেষণায় পরে জানা গেল, সেই অণুজীবটি প্রকৃতপক্ষে নতুন একটি অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে।

২০১৫ সালের মাঝামাঝি এসে গবেষকেরা পাটের বীজ, পাতা ও শিকড় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এর মধ্যে ৫০টির বেশি মাইক্রক্স ব্যাকটেরিয়া এবং ৩৫টির মতো ছত্রাকের সন্ধান পান। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল কম্পাউন্ড তৈরি করে।

অধ্যাপক হাসিনা খান বলেন, পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এই অণুজীবগুলো বেঁচে থাকে। এগুলো উদ্ভিদের কাছ থেকে পুষ্টি, রসদ নিয়ে থাকে। উদ্ভিদ ও অনুজীব—দুই পক্ষই উপকার পায়। এরপর অণুজীবগুলোকে আলাদা করা হয়। গবেষণা করে দেখা হচ্ছিল, এগুলোর মধ্যে কোনো উপকারী ব্যাকটেরিয়া আছে কি না।

মিলল নতুন ব্যাকটেরিয়া

২০১৮ সালে এসে বিজ্ঞানীরা বায়োইনফরমেটিকস সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিশ্চিত হন, পাটের মধ্যে স্টেফাইলোকক্কাস হোমিনিস নামের একটি নতুন ব্যাকটেরিয়া আছে, যা একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে। এবার শুরু হয় অ্যান্টিবায়োটিক বিশুদ্ধকরণের (পিউরিফিকেশন) কাজ। এ কাজে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক মো. আফতাব উদ্দিন। তিনি বলেন, দিন-রাত পরিশ্রম করে অ্যান্টিবায়োটিকটিকে বিশুদ্ধ করা হয়। এরপরে

এই অ্যান্টিবায়োটিকের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে আরও গভীর গবেষণা করা হয়। তখন এই কর্মযজ্ঞে বিসিএসআইআরের যন্ত্রপাতির সহায়তা নেওয়া হয়।

অধ্যাপক আফতাব উদ্দিন আরও বলেন, গবেষণায় ৫০টি অণুজীব থেকে একটিকে আলাদা করা হয়। সেটির পূর্ণাঙ্গ জিন–রহস্য উন্মোচন ও বিশ্লেষণ করে একটি নতুন জিন পাওয়া যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায়, ওই জিন নতুন একধরনের অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে, যা অভিনব (নভেল)। এই বিশুদ্ধকরণ খুব কসরতের একটি কাজ ছিল। অ্যান্টিবায়োটিকের নাম দেওয়া হয় ‘হোমিকরসিন’।

‘হোমিকরসিনে’ যা আছে

গবেষকেরা বলছেন, নতুন সন্ধান পাওয়া এই হোমিকরসিনে পাঁচটি ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) আছে। এগুলোর মধ্যে দুটি নিয়ে কাজ শেষ করেছেন বিজ্ঞানীরা। বাকি তিনটি ধরন নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চলছে। এগুলো থেকেও নতুন অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বিজ্ঞানীরা দেখলেন, হোমিকরসিন অ্যান্টিব্যায়োটিকটি প্রচলিত অ্যান্টিব্যায়োটিকের তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল। এটি উচ্চমাত্রার অম্ল ও ক্ষারে সক্রিয় থাকে। নতুন হোমিকরসিন পেপটাইড জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক। ফলে এটির বিরুদ্ধে অন্য ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধের ক্ষমতা কম।

অধ্যাপক হাসিনা খান বলেন, ‘পাটের এই অ্যান্টিবায়োটিক অনেক কার্যকর। মানব শরীরে যেসব ব্যাকটেরিয়া ক্ষতি করে, তাদের বিরুদ্ধে এটি কাজ করে। অণুজীব থেকে পাওয়া অ্যান্টিবায়োটিকগুলো দামে সাশ্রয়ী হবে। কারণ, রাসায়নিক প্রক্রিয়া থেকে তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক বেশ ব্যয়বহুল।’

গবেষণাটির সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক হাসিনা খান বলেন, কাজ অনেক বাকি। নতুন অ্যান্টিবায়োটিকটি মানব শরীরে গিয়ে ভেঙে যাবে। শরীরে প্রোটিন ভাঙার জন্যই নানা এনজাইম আছে। অ্যান্টিবায়োটিকটি শরীরে প্রবেশের পর যাতে ভেঙে না যায়, তা ঠেকাতে গবেষণা চলছে। তিনি বলেন, যে অণুজীব থেকে এই অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে, সেটি থেকে সরাসরি উৎপাদন কঠিন। তাই ওই অণুজীব থেকে জিন–রহস্যটি আলাদা করে এমন একটি অণুজীবে এটি বসানো হচ্ছে, যেটি থেকে সহজেই অনেক বেশি পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি সম্ভব।

দরকার আরও গবেষণা

হোমিকরসিন অ্যান্টিবায়োটিকটি আবিষ্কার–সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি এ বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞানীরা নেচার পাবলিশিং গ্রুপের সায়েন্টিফিক রিপোর্ট বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে জমা দেন। গত ২৭ মে ওই সাময়িকীতে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। জমা দিতে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়, যা গবেষকেরা নিজেরাই দিয়েছেন।

নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের বাণিজ্যিক রূপ

দিতে এখনো অনেক পথ বাকি বলে জানান বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিকটিকে প্রাণীর শরীরে প্রি-ক্লিনিক্যাল ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে হবে। গবেষণার সব কটি ধাপ পেরোলেই এটা মানুষের শরীরে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা যাবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন বড় অঙ্কের অর্থায়ন ও সহযোগিতা।

অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম বলেন, পাটের এই নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের টক্সিকোলজি টেস্ট (সাইটোটক্সিসিটি) করতে হবে, দেখতে হবে এটি মানব কোষে কোনো ধরনের সমস্যা তৈরি করে কি না বা মানব কোষ ভেঙে ফেলে কি না। এ ছাড়া প্রি–ক্লিনিক্যাল গবেষণা করে দেখতে হবে। ওই গবেষণায় যদি সাফল্য আসে, তাহলে পরবর্তীকালে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যেতে হবে।

অধ্যাপক আফতাব উদ্দিন বলেন, গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর যুক্তরাজ্যের আবেরদিন ইউনিভার্সিটির রয়াসন বিভাগের মেরিন বায়োডিসকভারি সেন্টারের অধ্যাপক মার্সেল জাসপার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁকে সেখানে গিয়ে গবেষণার অনুরোধ জানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমি চাই দেশেই গবেষণা করতে। এ জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা সুবিধা দরকার।’

‘গুরুত্ব অনেক’, তবে...অণুজীববিজ্ঞানী এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন মনে করেন, অধ্যাপক হাসিনা খান, রিয়াজুল ইসলাম ও আফতাব উদ্দিনের

গবেষণার গুরুত্ব অনেক এবং ভবিষ্যৎ ভালো। তিনি বলেন, নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার গবেষকদের জন্য বড় পাওয়া। তবে পরীক্ষায় অ্যান্টিবায়োটিকটি বিষাক্ত প্রমাণিত হলে বেশি দূর আগানো যাবে না। তখন অবশ্য এটিকে ‘মডিফিকেশন’ করে অন্য পদ্ধতিতে কাজে লাগানো যায় কি না, সেটি গবেষকেরা গবেষণা করে দেখতে পারবেন।

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, পৃথিবীতেই অ্যান্টিবায়োটিক ‘রেজিস্ট্যান্স’ যেভাবে বাড়ছে, সেই অনুপাতে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে আসছে না। অথচ নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের চাহিদা অনেক।