পাট উৎপাদন ও পাটজাত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ সমস্যা ও সম্ভাবনা

৩০ আগস্ট ২০১৬, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘পাট উৎপাদন ও পাটজাত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
সহযোগিতায়: 

.
.
.
.


যাঁরা অংশ নিলেন

মির্জা আজম : সাংসদ, প্রতিমন্ত্রী, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়
নারায়ণ চন্দ্র সরকার : অতিরিক্ত সচিব, প্রজেক্ট ডিরেক্টর (অতিরিক্ত), পাট অধিদপ্তর
হুমায়ুন খালেদ : সাবেক চেয়ারম্যান, বিজেএমসি
তপন কুমার নাথ : উপসচিব, পরিকল্পনা কমিশন
নাসিমা বেগম : নির্বাহী পরিচালক, জেডিপিসি
এস এম শাহীন আনোয়ার : মহাব্যবস্থাপক, এসএমই ফাউন্ডেশন
জেমি টার্জি : কান্ট্রি ডিরেক্টর, কেয়ার বাংলাদেশ
মো. আবদুর রউফ : পরিচালক, পণ্য, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো
মোহাম্মদ শামস-উজ-জোহা : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন
মাহমুদুল হক : উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা জুট মিলস ও বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন
এ বারিক খান : সচিব, বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ)
আনোয়ারুল হক : ডিরেক্টর, ইআরপিপি, কেয়ার বাংলাদেশ
শেখর ভট্টাচার্য : টিম লিডার, সুইচ এশিয়া জুট ভ্যালু চেইন প্রজেক্ট, কেয়ার বাংলাদেশ
মো. রাশেদুল করিম : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ক্রিয়েশন (প্রা.) লি.
সান্ত্বনা মোমতাজ : প্রেসিডেন্ট, সুইচ টু জুট কনসোর্টিয়াম
মোসাম্মাৎ ফেন্সি বেগম : পাটপণ্য উৎপাদনকারী, পায়রা বন্দর, রংপুর
মো. আলী হোসেন : পাটচাষি, রংপুর
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনায় সুপারিশ
 পাটপণ্য উৎপাদন, বৈচিত্র্যকরণ ও রপ্তানিতে বেশি করে উৎসাহ ভাতা দেওয়া প্রয়োজন
 পাটপণ্যের মোড়কজাতকে যেমন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তেমনি সরকারি–বেসরকারি খাতে ব্যাপক পরিমাণ উন্নত চট (জিও টেক্সটাইল) ব্যবহার হয়। এর মূল্য প্রায় ৮৫ মিলিয়ন ডলার। এ ক্ষেেত্র দেশীয় চটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।
 প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাটশিল্পের সঙ্গে প্রায় চার কোটি মানুষ জড়িত। এ শিেল্প ২ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন
 িবএডিসিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে পাট উৎপাদনের প্রধান উপকরণ বীজের সংকট দূর করার জন্য জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: আমরা চাই আমাদের অতীত ঐতিহ্য ফিরে আসুক। সোনালি আঁশ নিয়ে আবার গর্ব করতে চাই। পাট আবার সেই হারানো গৌরব ফিরে পাচ্ছে। আমাদের জন্য এটা খুবই খুশির খবর। আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশি পাটের অবস্থান শক্তিশালী করতে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। এসবই আজকের আলোচনার বিষয়। এখন আলোচনা করবেন মির্জা আজম।

মির্জা আজম
মির্জা আজম

মির্জা আজম: পাট উৎপাদন-সংশ্লিষ্ট বিষয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের। এর বাজার ও অন্যান্য বিষয় দেখে পাট মন্ত্রণালয়। একসময় পাট ছিল একমাত্র প্রধান রপ্তানিকারী ফসল। পাট আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে পাট নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। যেমন পাটকল বন্ধের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে বিশ্বব্যাংকের দেশীয় প্রতিনিধির কাছে। বেসরকারীকরণের নামে লুটপাট হয়েছে। পাটকলগুলো নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। মিলের গাছপালা, যন্ত্রপাতি, ঘর প্রায় সবই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি জমির ওপর ঘর করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
২০০২ সালে আদমজী জুট মিল বন্ধ করে বাংলাদেশের একটা ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা হয়েছে। ফলে বেকার হয়েছে হাজার হাজার শ্রমিক। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পাটকল বন্ধ করার জন্য অর্থসহায়তা দিয়েছে, আবার একই সময়ে ভারতে নয়টি পাটকলের উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ করেছে।
১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৯ শতাংশ আসত শুধু পাট থেকে। প্রধানমন্ত্রী পাটের জন্য যা যা করা দরকার, তার প্রায় সবই করেছেন।
২০১০ সালে বাধ্যতামূলক প্যাকেজ আইন চালু করেছি। ফলে স্থানীয় বাজারে পাটের চাহিদা অনেক বেড়েছে। পাটপণ্যের মেলায় ১০১ প্রকার পাটের পণ্য দেখেছি।
সবার চেষ্টায় পাটের হারানো গৌরব আবার ফিরিয়ে আনতে পারব। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।

জেমি টার্জি
জেমি টার্জি

জেমি টার্জি: বাংলাদেশে পাটের টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন দুই-তিন বছর ধরে কাজ করছে। আমরাও চাই পাটের হারানো গৌরব ফিরে আসুক। এ দেশের মানুষ যেন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন মোড়কজাত পণ্য ব্যবহার না করে। বিশেষ করে, পলিথিনের মতো পণ্য যেন একেবারেই ব্যবহার না করা হয়।
পাট অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব পণ্য। তাই স্থানীয়ভাবে মোড়কসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাটের ব্যবহার যেন বৃদ্ধি পায়। দেশীয়ভাবে পাটের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়লে মানুষের জীবনযাত্রার মানও অনেক বাড়বে।
নারীরা পাট দিয়ে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য তৈরি করতে পারেন। তাঁদের তৈরি দ্রব্যের মানও ভালো। ফলে পাটের মাধ্যমে নারীদের আয় বাড়বে, একই সঙ্গে সমাজে তাঁদের ক্ষমতায়ন বাড়বে। পাটপণ্য দেশের লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারে।
পাটের টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। তাই পাটের উন্নয়নে সরকারসহ এ দেশের সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

মো. আলী হোসেন
মো. আলী হোসেন

মো. আলী হোসেন: আমাদের পূর্বপুরুষ পাট চাষ করত। তারা নিজেরা বীজ তৈরি করত। এখন আমাদের পাট চাষের একটা বড় সমস্যা ভালো বীজের অভাব।
২০১৩ সালে সুইচ এশিয়া আমাদের শেখায় কীভাবে জমি ও বীজ তৈরি করতে হয়, কীভাবে নতুন পদ্ধতিতে চাষ করা যায়, কীভাবে রিবন রাইডিং যন্ত্রের সাহায্যে কম পানি দিয়েই পাট পরিষ্কার করা যায়। তাদের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে আমাদের এলাকায় পাট চাষ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
এখন আমাদের প্রধান সমস্যা হলো ন্যায্যমূল্যের। কৃষক যদি পাটের ন্যায্যমূল্য পান, তাহলে তাঁরা আরও বেশি করে পাট চাষ করবেন। এ জন্য মন্ত্রীর কাছে বিশেষ অনুরোধ, তিনি যেন পাটের ন্যায্যমূল্যের ব্যবস্থা করেন।

এ বারিক খান
এ বারিক খান

এ বারিক খান: ১৯৭২ সালে এ দেশের জুট মিলগুলো সরকারীকরণ করা হয়। ১৯৮৩ সালে আবার এগুলো বেসরকারি খাতে দেওয়া হয়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি পাটকলগুলো সমানভাবে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। ১৯৯০ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাংকের পরিকল্পনায় সরকারি-বেসরকারি পাটকলগুলোর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়।
১৯৮৮ সাল থেকে পোশাক ও টেক্সটাইল-শিল্প ২ শতাংশ ঋণে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পায়। কিন্তু পাট কেনার জন্য গড়ে ২০ থেকে ২১ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে পাট কিনতে হয়। কীভাবে বাংলাদেশে পাটকল টিকে থাকবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৬ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল আছে। পোশাকশিল্পসহ অনেক শিল্প এখান থেকে মাত্র ২ শতাংশ সুদে ঋণ পায়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাটশিল্পের সঙ্গে চার কোটি মানুষ জড়িত, অথচ এ শিল্প এই সুদ পায় না।
আশা করি ব্যাংকঋণ ও বেশি সুদের সমস্যা থাকবে না। বর্তমান পাট প্রতিমন্ত্রী অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। আবার পাটের সুদিন আবার ফিরে আসবে।

হুমায়ুন খালেদ
হুমায়ুন খালেদ

হুমায়ুন খালেদ: দেশের স্বাধীনতা ও পাট কিন্তু একসূত্রে গাঁথা। স্বাধীনতার পর এখনই পাটের সেরা সময় বলতে হবে। পাটশিল্পের জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল না। এক সরকার বলে সব পাটকল বন্ধ করো, আরেকজন বলে লিজ দাও। সিদ্ধান্তহীনতা ও সঠিক নীতির অভাবে পাটের দুর্দশা হয়েছে। বর্তমান সরকার সব পাটকল চালু করেছে।
পাটশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর বিভিন্ন বিভাগে ১২ কোটি ৭০ লাখ বর্গমিটার উন্নত ধরনের চট (জুট জিও টেক্সটাইল) লাগে। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন এর সম্পূর্ণই উৎপাদন করতে পারে।
চটের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সরকার পরিকল্পনা করেছে। এখন এটি জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে।
দেশীয় চটের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এখান থেকে বছরে ৮৫ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারি। পাট নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাসহ সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

আনোয়ারুল হক:
আনোয়ারুল হক:

আনোয়ারুল হক: পাটচাষিদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ভালো বীজের। মাত্র ৩৩ শতাংশ চাষি ভালো বীজ পাচ্ছেন। এ জন্য কৃষকের নির্ভর করতে হয় ভারত থেকে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের বীজের ওপর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমদানি করা বীজের মান ঠিক থাকে না।
বীজ ভালো না হলে পাট ভালো হবে না। পাট ভালো না হলে পরবর্তী সবকিছু থেমে যাবে। বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন সংস্থাকে (বিএডিসি) এ ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যখন একটা কাজের আদেশ পান, তখন তাঁরা ভালো আঁশ পান না।
আমাদের দেশের ভালো আঁশগুলো ভারত কিনে নেয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ভারতের কাছেই মার খাচ্ছেন। আমরা প্রচলিত নকশায় কাজ করি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হলে নকশায় বৈচিত্র্য আনতে হয়। এর জন্য এনজিও, উদ্যোক্তা, পাট মন্ত্রণালয় সবার একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।
২০১৪ সালের পাটনীতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত করা দরকার। পাটনীতি চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়ায় মন্ত্রণালয় প্রয়োজন মনে করলে আমরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারি।

মোসাম্মাৎ ফেন্সি বেগম
মোসাম্মাৎ ফেন্সি বেগম

মোসাম্মাৎ ফেন্সি বেগম: ২০১৩ সালে সুইচ এশিয়ার কাছ থেকে আমরা প্রশিক্ষণ পাই। বিভিন্ন ধরনের পাটের পণ্য তৈরি করি। আমাদের কাছ থেকে এ পণ্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা কিনে নেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বড় ব্যবসায়ীরা নেন।
আমাদের মূলধনের খুব অভাব। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, তিনি যেন আমাদের সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কৃষকের পরেই আমরা।
এখন আমরা মাসে গড়ে তিন হাজার টাকা আয় করি। ঋণ পেলে বেশি বৈচিত্র্যের পণ্য তৈরি করতে পারব। তাতে আমাদের আয় বাড়বে। বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দেশেরও উন্নয়ন হবে। আমাদের ছোট ছোট উদ্যোগ যেন মাঝপথে থেমে না যায়, মন্ত্রী সেটা বিবেচনা করবেন বলে আশা করি।

সান্ত্বনা মোমতাজ
সান্ত্বনা মোমতাজ

সান্ত্বনা মোমতাজ: আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সুইচ টু কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে আরও বেশি উৎপাদন ও রপ্তানি করা। এ দেশের মতো এত ভালো পাট পৃথিবীর আর কোথাও হয় না।
আজ কেয়ার বাংলাদেশের উদ্যোগে ছোট উদ্যোক্তারা এক হয়ে কাজ করতে পারছি। শিল্প মন্ত্রণালয় পাটজাত খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এখানে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অনেক।
আমাদের কাজের প্রধান সমস্যা মানসম্মত কাঁচা পাট। ভালো পাটের অভাবে ঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে পারি না।
আমাদের ১৬ কোটি মানুষের এ দেশ। দেশেই পাটের বিশাল বাজার রয়েছে। দেশে চাহিদা সৃষ্টি করতে পারলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের আয় বাড়বে। দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।
আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করব, দেশে যেন পাটপণ্যের বেশি করে মেলা হয়। সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যায়। দেশব্যাপী পাটপণ্য ব্যবহারের সচেতনতা, বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়ার সুযোগ, নকশাকেন্দ্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা পেলে আমরা অনেক দূর যেতে পারব।

শেখর ভট্টাচার্য:
শেখর ভট্টাচার্য:

শেখর ভট্টাচার্য: পাটের উৎপাদক ও যাঁরা পাটপণ্য তৈরি করেন, তাঁদের নিয়ে শিখন কর্মশালা করেছি। তাঁদের কিছু সুপারিশ আলোচনায় আনতে চাই। এর মধ্যে রয়েছে পাটনীতি ২০১৪–এর দ্রুত বাস্তবায়ন। পেঁয়াজ–রসুনচাষিদের মতো পাটচাষিদেরও ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া, সরকারি গুদামে পাট বিক্রয় করলে দুই-তিন মাস অপেক্ষা না করে পাটচাষিরা যেন সঙ্গে সঙ্গে পাটের মূল্য পান, সে জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা, আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো কীভাবে ভালো করছে, আমরা কেন খারাপ করছি, তার তুলনামূলক বিচার ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
পাট মানে শুধু মোড়ক নয়, আরও অনেক ধরনের পাটের ব্যবহার রয়েছে। পাটের এসব ব্যবহারকে সরকারের পক্ষ থেকে বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
পাট উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে পাটের উৎপাদন, বিপণনসহ এ-সংক্রান্ত সব বিষয় নিয়ে তথ্যকেন্দ্র করা প্রয়োজন। পাট ও বস্ত্র, পরিবেশ ও বন, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে একটি তদারক সংস্থা হওয়া প্রয়োজন। তাহলে ভবিষ্যতে পাটের বহুমুখী ব্যবহার ও বাজার সম্প্রসারণ দ্রুত হবে।

নাসিমা বেগম:
নাসিমা বেগম:

নাসিমা বেগম: আশির দশকে পলিথিনের জন্য পাটের চাহিদা কমে যায়। তখন পাটপণ্যকে বহুমুখী করার জন্য পাটের বহুমুখী ব্যবহারকরণ প্রতিষ্ঠান করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো পাটপণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা দেওয়া।
পাটপণ্য বাজারজাত করার জন্য দেশের ভেতর ও দেশের বাইরে মেলা করে থাকি। আমাদের এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় ৩০০ উদ্যোক্তা বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন করছেন। ইউরোপ, আমেরিকাতেও এগুলো বাজারজাত হচ্ছে। এমনও উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা ১০০ ভাগ পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করেন।
প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালের শুরুর দিকে সবাইকে পাটপণ্য ব্যবহারের জন্য অনুশাসন দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত আমাদের উদ্যোক্তারা ১৩৩ প্রকার পাটপণ্য উৎপাদন করেছেন। আমাদের পণ্যগুলো অনেক সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব, অথচ আমরা নিজেরাই অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি না।
দেশের ছয়টি জেলায় সহায়তাকেন্দ্র আছে। এখান থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাসহ সবাই সহায়তা পেতে পারেন। আপনাদের যেকোনো সমস্যায় আমরা সহযোগিতা করতে চেষ্টা করব।

মো. রাশেদুল করিম
মো. রাশেদুল করিম

মো. রাশেদুল করিম: ১৫ বছর ধরে বিশ্বে পরিবেশবান্ধব (গ্রিন) দ্রব্যের চাহিদা বাড়ছে। প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চাহিদা বাড়ছে। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা মোড়কসহ মাত্র কয়েকটি পণ্য উৎপাদন করি। কিন্তু বিশ্ববাজারে ওয়াল কাভারিং, হোম টেক্সটাইল, হাউসহোল্ড প্রোডাক্টস, লাইফস্টাইল, ফুটওয়্যার ইত্যাদি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা রয়েছে।
আমাদের সীমাবদ্ধতা হলো, এ ধরনের পণ্য আমাদের নেই, তাই এ বাজারে প্রবেশ করতে পারছি না। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতে প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি এসব পণ্য তৈরির জন্য তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সহযোগিতা পেয়েছে।
সারা বিশ্বে ৫০০ বিলিয়ন বাজারের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এর মাত্র কয়েক শতাংশও যদি আমরা সরবরাহ করতে পারি, তাহলে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারি। তবে আশার কথা হলো, বর্তমান পাট প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে পাটপণ্যের বৈচিত্র্যকরণের ক্ষেত্রে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাফল্য অর্জন করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।

মোহাম্মদ শামস-উজ-জোহা
মোহাম্মদ শামস-উজ-জোহা

মোহাম্মদ শামস-উজ-জোহা: এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয় জড়িত। ফলে কাজ করার সময় মন্ত্রণালয়কে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের জন্য কাজ এগোয় না।
ব্যাংক ও ক্লায়েন্টের সম্পর্ক কী হবে, এ সংজ্ঞা ঠিক করতে সময় লেগেছে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। ডাক্তার রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দিলেন। রোগী না বুঝতে পারায় পরিষ্কার করে লিখতে বললেন। ডাক্তারের পরিষ্কার করে লিখতে সময় লাগল চার বছর। রোগী কি বাঁচবে?
আমরা সবাই মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে আছি। যত বাধা আসুক, তিনি যেন তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজ করেন। আমরা সবাই তাঁর সঙ্গে আছি, থাকব।

মাহমুদুল হক
মাহমুদুল হক

মাহমুদুল হক: ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে কোনো পাটকল ছিল না। সে সময়ে ১০০ ভাগ কাঁচা পাট রপ্তানি হতো। ১৯৭১ সালে ৫০ শতাংশ কাঁচা পাট ও ৫০ শতাংশ উৎপাদিত দ্রব্য হিসেবে রপ্তানি হতো। ২০১৫ সালে, আমার ধারণা, ১৫ শতাংশ কাঁচা পাট আর ৮৫ শতাংশ উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানি হয়েছে।
আমার ধারণা, ১৯৭১ সালে সব মিলিয়ে আমাদের পাট খাতে রপ্তানি ছিল ৫ লাখ ৫০ হাজার টন। আজ সব মিলিয়ে রপ্তানি হচ্ছে আড়াই লাখ টন। বিশ্ববাজারে তিন লাখ টনের বাজার হারিয়েছি। মনে করি না এটা ফিরে আসা সম্ভব। ১৯৭০ সালে ১৫ হাজার টন পাটের সুতা রপ্তানি হতো, আজ সেটা ৬ লাখ টনে পৌঁছেছে। এ খাতে অনেক বেশি এগিয়েছি।
আমাদের করণীয় হলো বিদেশে নামকরা বাণিজ্য মেলায় নিজেদের পণ্যের প্রদর্শন। তাহলে রং, নকশা, অন্যরা কী করছে, আরও কী করার আছে—সব জানা যাবে। মেলাসহ অন্যান্য বিষয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে পদক্ষেপ নিলে আমরা সফল হতে পারব।

এস এম শাহীন আনোয়ার
এস এম শাহীন আনোয়ার

এস এম শাহীন আনোয়ার: একজন উদ্যোক্তা শুধু পণ্য উৎপাদন করতে পারলেই তাঁর কাজ শেষ হয় না। তাঁকে ব্যবসা, হিসাব, বাজার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানতে হয়। আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে সহায়তা করে থাকি।
রংপুরের পাটের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করছি। উদ্যোক্তারা কাঁচামালের সংকটের কথা বলেছেন। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি পাটপণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহের উদ্যোক্তা হতে চায়, আমরা সে ক্ষেত্রে সহায়তা দেব।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, জুট ডাইভারসিফিকেশন সেন্টার, এসএমই ফাউন্ডেশন—সবাই একসঙ্গে কাজ করলে দ্রুতগতিতে পাটপণ্যের সম্প্রসারণ হবে।

মো. আবদুর রউফ
মো. আবদুর রউফ

মো. আবদুর রউফ: ২০১০-১১ সালে পাট খাত থেকে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় হয়েছে। গত অর্থবছরে এটা কমে হয়েছে ৯১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কী জন্য রপ্তানি কমেছে, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পাটপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হলে এর উপযোগ তৈরি করতে হবে। পাট প্লাস্টিক, বস্ত্র, চামড়া ও কাঠের বিকল্প হতে পারে।
আমাদের পণ্যের বাজারজাতকরণের অনেক দুর্বলতা আছে। একটা জরিপ থেকে দেখেছি, বিশ্বে ১ হাজার ১০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিকল্প পণ্যের চাহিদা আছে। এর সামান্য পরিমাণও যদি পাট থেকে দিতে পারি, সেটা আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন হবে।
আমরা বিশ্বের ১ নম্বর পাট উৎপাদনকারী দেশ, অথচ বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আমাদের নেই। পাটপণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক গবেষণা করতে হবে। পণ্য রপ্তানির দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পণ্যের মান ও মূল্য।

তপন কুমার নাথ
তপন কুমার নাথ

তপন কুমার নাথ: মাননীয় মন্ত্রীর নির্দেশে আমরা কয়েকজন মিসর, ইরান, তুরস্ক ও দুবাই গিয়েছি। এসব দেশে আমাদের পাটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা পূরণ করতে পারি না।
পাটকলের যন্ত্রগুলো ১৯৫৯ সালের আগে কেনা। বর্তমান পাট প্রতিমন্ত্রী এসব ক্ষেত্রে অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর বিশেষ উদ্যোগে পাটপণ্যের ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন এসেছে।
পাটপণ্যের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দিলে অর্থের সমস্যা হবে বলে মনে করি না। আমার সুপারিশ হলো, মন্ত্রণালয়ের কয়েকজনকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া। ইনসেনটিভ বা উৎসাহ ভাতা দেওয়া। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কার্যকর কর্মপরিকল্পনা করা।
অবকাঠামো, আইনের সঠিক প্রয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঠিকভাবে কাজ করলে পাটপণ্যের আরও উন্নয়ন হবে।

নারায়ণ চন্দ্র সরকার
নারায়ণ চন্দ্র সরকার

নারায়ণ চন্দ্র সরকার: আমাদের মূল কাজ হলো পাট উৎপাদন। এ জন্য কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া। পাট যদি উৎপাদিত না হয়, তাহলে কোনো কিছুই করতে পারব না। ২০০টি উপজেলা ও ৪৪টি জেলায় আমাদের কার্যক্রম বিস্তৃত। এখানে আমরা কৃষকদের বিভিন্নভাবে প্রণোদনা দিয়ে থাকি।
কীটনাশক, সার, পাট পরিষ্কারের উপকরণ, বীজ শুকানোর শিট ইত্যাদি দিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করে থাকি। এ দেশে উৎপাদিত বীজের মান সবচেয়ে ভালো। এখন আমাদের অন্যতম প্রধান কাজ হলো দেশীয় বীজের সমস্যা দ্রুত নিরসন করা।
মির্জা আজম: পাট উৎপাদনের প্রধান উপকরণ বীজ। প্রায় ৮০ শতাংশ বীজের জন্য আমাদের ভারতের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাধ্যতামূলক মোড়কের কার্যক্রমের জন্য কিছুদিন ভারতে পাট রপ্তানি বন্ধ রেখেছিলাম। তখন কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল যে ভারত আবার বীজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় কি না।
এখন কৃষকের পাটের মূল্য নিয়ে খুব একটা অভিযোগ নেই। কারণ, সরকার বেশি দামে পাট ক্রয় করছে। এক হেক্টর পাটের খেত থেকে ১১ মেট্রিক টন অক্সিজেন নির্গত হয়, আর ১২ মেট্রিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষিত হয়। অথচ পরিবেশবান্ধব তহবিলের (গ্রিন ফান্ড) কোনো সুযোগ আমরা পাই না।

স্থানীয় বাজারের ভালো মানের পাটের চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ করার পর রপ্তানির ব্যাপারে আমরা ভাবব। পাটপণ্যের উন্নয়নে যা করা দরকার, প্রধানমন্ত্রী এর সবই করবেন।
ফ্যাশন ডিজাইনের জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যা করা প্রয়োজন, আমরা সেটা করব। পাটনীতি ও আইন দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংসদে পাস হবে।
আমাদের এলাকায় তিন দিনের একটি পাটপণ্যের মেলার সব পণ্যই এক বিকেলে শেষ হয়ে গেল। শুধু আন্তর্জাতিক বাজার নয়, আমাদের দেশীয় পাটপণ্যের বাজার অনেক বড়।

আব্দুল কাইয়ুম: আমাদের পাটের ঐতিহ্য সুবিদিত। কিন্তু আজ পাট উৎপাদনের প্রধান উপকরণ বীজের জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করতে হয়। আলোচনা এসেছে, বিভিন্ন ধরনের নিম্নমানের বীজ আমদানি হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পাটপণ্যের বৈচিত্র্যকরণ। এ দুটো বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাই অনেক বেশি গুরুত্ব দেবেন বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।