পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রণ
হবিগঞ্জ পৌরসভার ৯০ ভাগ বাসিন্দা মাত্রাতিরিক্ত আয়রনযুক্ত পানি ব্যবহার করছে। এতে যেমন বিভিন্ন রোগবালাই ছড়াচ্ছে, তেমনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সামগ্রী।
হবিগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফিরোজ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে একেক জায়গায় আয়রনের মাত্রা একেক রকম হয়। হবিগঞ্জ পৌর এলাকার পানিতে এক থেকে তিন পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) আয়রন রয়েছে। এক থেকে দুই পিপিএম মাত্রার আয়রন গ্রহণযোগ্য। এর বেশি হলে আয়রনের মাত্রা কমিয়ে পানি ব্যবহার করা উচিত।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, পানিতে এক পিপিএমের বেশি আয়রন থাকলেই তা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। হবিগঞ্জ পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, প্রথম শ্রেণির এই পৌরসভায় প্রায় এক লাখ মানুষের বসবাস। পানি সরবরাহকেন্দ্র আছে মাত্র দুটি। একটি হবিগঞ্জ শহরের প্রধান সড়কের আর ডি হলের পশ্চিমে ও অপরটি ফায়ার সার্ভিস সড়কে অবস্থিত। পরীক্ষায় সেখানকার পানিতে আয়রনের মাত্রা সহনীয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। পৌরসভার হিসাব অনুযায়ী, এ দুটি কেন্দ্র থেকে পৌরসভার ৩৮ ভাগ এলাকায় পানি সরবরাহ করা হয়। তবে সেখানকার সবাই এই পানি পাচ্ছে, বিষয়টি তেমন নয়। এই ৩৮ ভাগ এলাকায় মাত্র ১ হাজার ৯৭৬ জন গ্রাহককে পানি সরবরাহ করে পৌরসভা। প্রতিটি পরিবারে গড়ে ৫ জন করে ধরলে মাত্র ১০ হাজারের মতো পৌরবাসী বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে। সে হিসাবে পৌরসভাভুক্ত ১ লাখ মানুষের মধ্যে ৯০ শতাংশই আয়রনযুক্ত পানি ব্যবহার করছে।
বিপুলসংখ্যক মানুষের ভরসা নিজস্ব নলকূপ বা গভীর নলকূপ। তবে ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় এভাবে দেড় শ থেকে দুই শ ফুট মাটির নিচ থেকে তোলা পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন থাকছে। এ কারণে পৌরবাসী পানি নিয়ে বড় সমস্যায় আছে।
১৩ জুলাই শহরের শায়েস্তানগর আবাসিক এলাকার ফাতেমা-কাদির হাউসে গিয়ে দেখা যায়, বাসার তত্ত্বাবধায়ক আরজু মিয়া আরও একজনকে সঙ্গে নিয়ে বাসার ছাদের ওপর স্থাপিত একটি পানির ট্যাংক পরিষ্কার করছেন। ট্যাংক থেকে হলুদ রঙের ঘোলাটে ময়লা পানি বেরিয়ে আসছে। জিজ্ঞাসা করতেই আরজু মিয়া বললেন, ‘প্রতি সপ্তাহে এ ট্যাংক পরিষ্কার করি, আবার আয়রনে ভরে যায়। শহরের অধিকাংশ বাসাবাড়িতে একই অবস্থা।’
শহরের অনন্তপুর আবাসিক এলাকার অধিবাসী আলাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, এ এলাকায় পৌরসভার পানি সরবরাহ করা হয় না। ফলে সবাই গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করছেন। নলকূপের পানিতে যে অতিমাত্রায় আয়রন আছে, তা তাঁরা জানেন। কিন্তু বিকল্প না থাকায় এই পানিই ব্যবহার করতে হচ্ছে।
শহরের কুরেশনগর আবাসিক এলাকার স্কুলশিক্ষিকা নাজমা বেগম বলেন, আয়রনযুক্ত পানি ব্যবহার করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে চুলকানি, পেটের পীড়া, মাথার চুল ঝরে পড়া ইত্যাদি সমস্যা হচ্ছে।
পৌরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানিতে আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকার কারণে কাপড়চোপড় ভালোভাবে পরিষ্কার করা যায় না। এক-দুই ধোয়া দিলেই নতুন কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া বাড়ির গোসলখানা বা শৌচাগারের টাইলস, বেসিন ও পানি সরবরাহের পাইপসহ অন্যান্য সামগ্রী পরিষ্কার রাখা যায় না। সেগুলোতে আয়রন জমে লালচে দাগ পড়ে যায়। বাধ্য হয়ে কিছুদিন পরপরই এসব সামগ্রী বদলে নিতে হচ্ছে।
হবিগঞ্জ পৌর পানি সরবরাহকেন্দ্রের প্রকৌশলী আবদুল কুদ্দুস বলেন, হবিগঞ্জে পানিতে আয়রনের পরিমাণ একটু বেশি, এটা সত্য। হবিগঞ্জে পরীক্ষাগার না থাকায় তাঁরা সিলেটে গিয়ে মাঝেমধ্যে পানি পরীক্ষা করিয়ে আনেন। হবিগঞ্জ শহরের দুটি পানি সরবরাহকেন্দ্রের মাধ্যমে ২ লাখ ৯৪ হাজার গ্যালন পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এতে করে পৌর এলাকার ৩৮ ভাগ মানুষ এই আয়রনমুক্ত পানি পাচ্ছে। শহরের শ্মশানঘাট এলাকায় নতুন একটি পানি সরবরাহকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। সেটি চালু হলে আরও আড়াই লাখ গ্যালন পানি সরবরাহ করা যাবে। পর্যায়ক্রমে পুরো পৌরসভাকে আয়রনমুক্ত পানির আওতায় আনার পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ রকম আরও তিনটি কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে পৌরসভার সব নাগরিক বিশুদ্ধ পানির আওতায় আসবে।