পান্তায় আছে পুষ্টি, দ্রুত জোগায় শক্তি

আজ পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখে পান্তাভাত খাওয়া এখন উৎসবের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীসহ বড় বড় শহরে পান্তাভাত খাওয়া উন্মাদনার পর্যায়ে পৌঁছেছে। বড়, মাঝারি ও ফুটপাতের হোটেলে বসে মানুষ আজ নিশ্চিন্তে পান্তা খাচ্ছে। খেতে না পারলেই আক্ষেপ। অন্যদিকে গ্রামের মানুষের কাছে পান্তাভাত জীবনেরই অংশ। শহর বা গ্রামের কারও কাছে পান্তাভাতের পুষ্টিগুণের বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই।

তবে পান্তাভাত পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। সাদাভাতের চেয়ে পুষ্টিমানে এগিয়ে পান্তাভাত। পান্তাভাতে বেশি পরিমাণে আয়রন, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম আছে। দ্রুত শক্তি জোগায় বলে কায়িক পরিশ্রম করা মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে পান্তাভাতের সুফল পান। রক্তস্বল্পতার শিকার মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবার পান্তাভাত।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পুষ্টি ইউনিটের বিশ্লেষণ ও ভারতের আসাম রাজ্যের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিদ্যা বিভাগের গবেষণায় পান্তাভাতের পুষ্টিগুণের এই তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলা প্রবাদে আছে ‘পান্তাভাতের জল, তিন পুরুষের বল’। গবেষণায় এসেছে, পান্তা-ভাতে থাকা উন্নত মানের শর্করা শরীরে দ্রুত শক্তি জোগায়। এর সত্যতা মিলল মাটিকাটা শ্রমিক মো. সোবহান মিয়ার কথায়। নিয়মিত পান্তা খাওয়া পেটানো শরীরের এই মানুষের সঙ্গে মালিবাগ বাজারের কাছে ফুটপাতে কথা হয়। সোবহান জানালেন, সকালে খেয়েছেন পান্তা আর আলুভর্তা। পান্তার উপকার সম্পর্কে বললেন, ‘শইল (শরীর) ঠান্ডা থাহে। পেট ভালো থাহে। পান্তা খাইলে অনেক বেলা পর্যন্ত কাম করন যায়।’

পেটের সুস্থতায় পান্তা
বিএআরসির পুষ্টি ইউনিট ২০১৫ সালে পান্তাভাতের অণু পুষ্টিকণা পরিমাপ করে। তাতে দেখা গেছে, প্রতি ১০০ গ্রাম পান্তাভাতে ৬৮ দশমিক ৭ মিলিগ্রাম আয়রন আছে, যা সাদাভাতে ২ দশমিক ৯ মিলিগ্রাম। পান্তাভাতে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ৭৮৫ মিলিগ্রাম, যা সাদাভাতে ২০ দশমিক ৩৫ মিলিগ্রাম। পান্তাভাতে পটাশিয়ামের পরিমাণ ৭৯৯ মিলিগ্রাম, যা সাদাভাতে ৭৭ মিলিগ্রাম।

বিএআরসির বিশ্লেষণ বলছে, ভাতকে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে গাঁজন প্রক্রিয়ায় তা ফাইটিক অ্যাসিড, হাইড্রোলাইসিস (পানির সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া) করে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এতে পান্তাভাতের গুণাগুণ বাড়ে এবং ভাতের অণুপুষ্টিগুলোকে মুক্ত করে। পান্তাকে ঠান্ডা খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিশুর জ্বর-জ্বর ভাব হলে পান্তাভাত তা উপশমে সাহায্য করে। এমনকি পেটের সুস্থতায় (ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য রক্ষায়) গাঁজায়িত খাবার পান্তা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

বিএআরসির পুষ্টি পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পান্তাভাত পুষ্টিমানে অনন্য। এতে আয়রন, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম বেশি থাকার কারণে এটি রক্তস্বল্পতা, অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, নারী, বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য উপযুক্ত খাবার। তবে পান্তা বানাতে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের পরামর্শ দেন এই পুষ্টিবিদ।

দ্রুত শক্তি দেয় পান্তা
পুষ্টিবিদেরা বলছেন, যেকোনো বয়সের মানুষই নিয়মিত পান্তাভাত খেতে পারে। কারণ, পান্তায় প্রচুর শর্করা আছে, যা দ্রুত শক্তি জোগায়। পান্তার সঙ্গে আলুভর্তা শরীরে শর্করার পরিমাণ বাড়ায়। তাই কায়িক পরিশ্রমের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, গরম আবহাওয়ায় পান্তাভাত খেলে শরীর ঠান্ডা থাকবে। উচ্চমাত্রায় পুষ্টির জন্য পান্তাভাত খাওয়ার পরমুহূর্তেই শরীরে তাৎক্ষণিক শক্তি আসবে। খেলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে। নিয়মিত পান্তা খেলে শরীরে কোনো ক্ষতি নেই।

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের ওডিশা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে বেশ জনপ্রিয় এক খাবারের নাম পান্তাভাত। ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে পান্তাভাত খাওয়ার চল আছে।
২০১৬ সালে ভারতের আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিদ্যা বিভাগের কয়েকজন অধ্যাপক পান্তাভাত নিয়ে গবেষণা চালান। রাসায়নিক বিশ্লেষণে তাঁরা দেখেন, ভাত ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে এটির অম্লত্ব বেড়ে যায় এবং ক্ষারত্ব কমে যায়। ভাত শর্করা। পানিতে ভেজালে গাঁজনকারী ব্যাকটেরিয়া বা ইস্ট এই শর্করা ভেঙে ইথানল ও ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে। ইথানলই পান্তাভাতের ভিন্ন রকম স্বাদ তৈরি করে।

তাঁদের গবেষণাও এসেছে, ১২ ঘণ্টা ভাত ভিজিয়ে রাখলে আয়রন, পটাশিয়াম আর ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই গবেষণা ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিলে এশিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক মধুমিতা বাড়োহার সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভাত পানিতে ভিজিয়ে রাখলে এর পুষ্টিগুণ যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি একই সঙ্গে পুষ্টি শোষক উপাদানগুলো কমে যায়। এই প্রথাগত খাবারটি নিঃসন্দেহে খনিজ উপাদানের বেশ ভালো একটি উৎস।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বললেন, ‘পয়লা বৈশাখে পান্তা খাওয়া বাঙালির সংস্কৃতিতে ছিল না, তবে সংস্কৃতি রূপান্তরশীল। তাই নববর্ষে পান্তা-ইলিশ আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।’