পাবর্ত্য তিন জেলায় করোনার মধ্যে ম্যালেরিয়াও বাড়ছে

  • এ বছর পার্বত্য তিন জেলার আক্রান্তদের মধ্যে বান্দরবানেই ৭৬ ভাগ। মারা যাওয়া তিনজনই এ জেলার বাসিন্দা।

  • সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় তিন পার্বত্য জেলায় ১০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩২ শতাংশ।

ফাইল ছবি।

করোনা মহামারির মধ্যেই তিন পার্বত্য জেলায় আতঙ্ক বাড়াচ্ছে ম্যালেরিয়া। গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পার্বত্য তিন জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এই সময়ে ম্যালেরিয়ায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আর গত বছর মারা গেছেন চারজন।

দুর্গম অঞ্চল হওয়ার জন্য নাজুক যোগাযোগব্যবস্থা, হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) না থাকা এবং প্রয়োজনের তুলনায় বিশেষ করে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতিকে ম্যালেরিয়া বেড়ে যাওয়া ও মৃত্যুর কারণ বলছেন চিকিৎসকেরা। এ ছাড়া ম্যালেরিয়া নিয়ে দুর্গম পাহাড়ে সচেতনতার অভাবও রয়েছে। যদিও সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা।

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পার্বত্য তিন জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ২১০ জন। মারা গেছেন ৩ জন।

রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও কুড়িগ্রাম—দেশের এই ১৩টি জেলা ম্যালেরিয়াপ্রবণ। এর মধ্যে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি—পার্বত্য এই তিন জেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় মশাবাহিত ম্যালেরিয়া রোগে। দেশের ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর ৯০ শতাংশই হয় পার্বত্য তিন জেলায়। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত পার্বত্য তিন জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ২১০ জন। গত বছর একই সময়ে আক্রান্ত ছিলেন ২ হাজার ১০৮ জন। এ বছর পার্বত্য তিন জেলার আক্রান্তদের মধ্যে বান্দরবানেই ৭৬ ভাগ। বাকিরা অন্য দুই জেলায়। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া তিনজনই বান্দরবানের বাসিন্দা।

বান্দরবানের সিভিল সার্জন অং সুই প্রু মারমা প্রথম আলোকে বলেন, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা গতবারের চেয়ে কিছু বেড়েছে। আবার এ জেলায় ইতিমধ্যে একজন ডেঙ্গু রোগীও শনাক্ত হয়েছে। তবে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়লেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।

ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি যখন উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, তখন পাহাড়ে করোনার সংক্রমণও বাড়ছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় তিন পার্বত্য জেলায় ১০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩২ শতাংশ। আর গতকাল সারা দেশে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় রাঙামাটিতে একজন এবং খাগড়াছড়িতে দুজন মারা গেছেন করোনায়। এখন পর্যন্ত তিন জেলায় মারা গেছেন ৭৩ জন। আর এ পর্যন্ত করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ৪৯৬ জন।

এবারের বৃষ্টির গতিপ্রকৃতি ম্যালেরিয়ার পক্ষে সহায়ক। টানা কয়েক দিন ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। আবার টানা রোদ। ম্যালেরিয়া ছড়ানো অ্যানোফিলিস মশা এই পরিস্থিতিতে বাড়ে।
আফসানা আলমগীর খান, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নির্মূল কর্মসূচি

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে তিন পার্বত্য জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা কমতে থাকে। এরপর কিছুটা বাড়ে ২০১৪ সালে। তখন ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৫১ হাজার ৮০। ২০১৯ সালে দেশে ১৭ হাজার ২২৫ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এর মধ্যে তিন পার্বত্য জেলাতেই আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ৪১৪। অর্থাৎ আক্রান্তের ৯৫ শতাংশ পার্বত্য এলাকার। গত বছর আক্রান্ত হন ৬ হাজার ১৩০ জন।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নির্মূল কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার আফসানা আলমগীর খান বলেন, ‘গতবার করোনার কারণে আমাদের মনোযোগ চলে গিয়েছিল সেদিকে। তাই গতবার যে কম শনাক্ত হয়েছিল, তাকে বিবেচনায় নেওয়া যাবে না। এবার বেশি শনাক্ত হচ্ছে। তবে এটা ২০১৯-এর তুলনায় বেশি নয়। ম্যালেরিয়া মোকাবিলায় এবার আমরা অনেক সজাগ আছি।’

আফসানা আলমগীর বলছেন, এবারের বৃষ্টির গতিপ্রকৃতি ম্যালেরিয়ার পক্ষে সহায়ক। এবার টানা কয়েক দিন ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। আবার টানা রোদ। ম্যালেরিয়া ছড়ানো অ্যানোফিলিস মশা এই পরিস্থিতিতে বাড়ে।

পাহাড়ে এবার যে তিনজন মারা গেছেন, তাঁদের দুজন বান্দরবানের লামা উপজেলার, একজন আলীকদমের। সবাই দুর্গম এলাকার বাসিন্দা। যে তিনজন মারা গেছেন, তাঁদের একজন লামার ১৭ বছরের এক গৃহবধূ। তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। জুন মাসে ম্যালেরিয়া শনাক্ত করার পর স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী তাঁর ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। একই সময়ে গর্ভজনিত একটি জটিলতায় তাঁকে লামার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। পরে জ্বর বেড়ে গেলে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষার পর ম্যালেরিয়ার পাশাপাশি তাঁর করোনাও শনাক্ত হয়েছিল।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নির্মূল কর্মসূচির বান্দরবানের সার্ভিল্যান্স মেডিকেল অফিসার মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এ ঘটনা জানার পর ওই নারীকে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রাখি। কিন্তু সেখানে এই জটিল রোগীকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া সম্ভব হয়নি স্বাভাবিকভাবেই। এরপর ছয় দিনের মাথায় তিনি মারা যান।’

পার্বত্য তিন জেলার কোনো হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। গত বছর যে দুজন বান্দরবানে মারা যান, তাঁদের আইসিইউতে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।

বান্দরবানের সার্ভিল্যান্স মেডিকেল অফিসার সিরাজুল ইসলাম বলেন, যদি আইসিইউ সাপোর্ট থাকত, তবে এসব মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হতো।

ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দুর্গম অঞ্চলে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর অধীন চার থেকে পাঁচটি গ্রাম থাকে। বর্ষার এই মৌসুমে পাহাড়ি ছড়াগুলো জলমগ্ন হয়ে যাওয়ায় যাতায়াত আরও কঠিন হয়ে পড়ে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা মনে করেন, পাহাড়ে যে ১১টি ভিন্ন জাতিসত্তা আছে, ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত সচেতনতামূলক বার্তা এসব মানুষের ভাষায় করা উচিত। তাতে প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিষয়ে খুব সহজেই দুর্গম এলাকার মানুষ ধারণা পেত। একই সঙ্গে অন্তত জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন জরুরি।

রাঙামাটির সিভিল সার্জন বিপাশ খীসা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা হিসেবে রাঙামাটিতে আইসিইউ সুবিধা দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। আশা করা যায় এবার সেই ব্যবস্থা করা হবে।’