
শীতের আগাম পাখির খোঁজে ২০ অক্টোবর ২০১৬ সালে ভাগনে তানভীরকে নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা হলাম। পরদিন সকালে পক্ষী আলোকচিত্রী মারুফ রানা, আরিফ ও শাওনকে নিয়ে নুরু মাঝির ইঞ্জিন বোটে চাপলাম। গত শীতের পদ্মার সঙ্গে এই পদ্মার কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না। এখনো বেশ পানি, পথ বেশ অচেনা লাগছে। নুরু মাঝি বললেন, ‘স্যার, গত পরশু কালো মানিকজোড় ও রঙ্গিলা বক দেখলাম।’ ‘তাই নাকি?’ উৎসুক দৃষ্টিতে বললাম আমি! ‘তাহলে তো সারসগুলোকে একটু খুঁজে দেখতে হয়!’ ওদের খোঁজে চর মাজারদিয়ার হয়ে চর খানপুরে এলাম, কিন্তু টিকিটির দেখাও পেলাম না। তবে একটি পাখির দেখা পেলাম কয়েকটি জায়গায়, যাকে গত মার্চ ও এপ্রিলের যাত্রায় দেখলেও ময়াল রাজহাঁসের খোঁজে ব্যস্ত থাকায় তখন সময় দিতে পারিনি। কিন্তু এবার ততটা ব্যস্ত না থাকায় একটু সময় দিলাম এবং বেশ কিছু ভালো ছবি তুললাম। এরপর খোশমেজাজে এগিয়ে চললাম সারসগুলোর খোঁজে এবং উড়ন্ত অবস্থায় খানপুরেই পেয়ে গেলাম কালো মানিকজোড়।
সারস খুঁজতে গিয়ে সেদিন যে পাখির ছবি তুললাম, সে শীতের পরিযায়ী পাখি পালাসের গাঙচিল। এ বছরের ১৮ মার্চ আবারও ওর সঙ্গে দেখা হলো পদ্মার চরে। মোট সাতটি পাখির দেখা পেয়েছিলাম এবার। এরা এ দেশে পালাসের গঙ্গা কইতর, বৃহৎ জলকবুতর, বড় জলকবুতর, গঙ্গা কৈতর বা বদর কৈতর নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Pallas’s Gull বা Greater Black-headed Gull। Laridae গোত্রের এই পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Larus ichthyaetus।
গাঙচিলদের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম পালাসের গাঙচিলের দৈর্ঘ্য ৬০-৭২ সেন্টিমিটার, প্রসারিত ডানা ১৫৫-১৭০ সেন্টিমিটার এবং ওজন ০.৯- ২.০ কেজি। প্রজননকালীন প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা, গলাসহ মুখমণ্ডল ভেলভেট কালো। পিঠের পালক ধূসর ও বুক-পেটের নিচের পালক ধবধবে সাদা। ডানার বাইরের কয়েকটি পালকের আগা কালো, এ ছাড়া বাকি সব পালক সাদা। লম্বা ও সরু ঠোঁটটি কমলা-হলুদ ও আগা গাঢ় রঙের। চোখের ওপরে ও নিচে অর্ধচন্দ্রাকৃতির পট্টি রয়েছে। প্রজননহীন পাখির মুখমণ্ডল সাদা; তবে চোখের চারদিক, কান-ঢাকনি ও মাথার পেছনে বাদামি ছিটেফোঁটা থাকে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপরটা গাঢ় বাদামি, নিচটা ফ্যাকাশে ও ঠোঁট ধূসরাভ।
এরা সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখি। উপকূলীয় এলাকা, জাহাজ বা লঞ্চঘাট, নদী ও হ্রদে বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুম ছাড়া অন্য সময় সচরাচর একাকী বা দু-তিনটিতে একসঙ্গে থকে। তবে মাছের আধিক্য থাকলে একসঙ্গে বহু পাখি দেখা যায়। মাছ মূল খাদ্য হলেও প্রয়োজনে কাঁকড়া, চিংড়িজাতীয় প্রাণী, কীটপতঙ্গ, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, পাখি, ডিম ইত্যাদিও খেতে পারে। পানির সামান্য ওপরে উড়ে উড়ে খাদ্য সংগ্রহ করে। শীতে সচরাচর নীরব থাকে, কিন্তু মাঝে মাঝে উচ্চকণ্ঠে ‘ক্রি-অ্যাব ক্রি-অ্যাব ক্রি-অ্যাব’ স্বরে ডাকে।
গ্রীষ্মে মধ্য এশিয়া, উত্তর-পশ্চিম মঙ্গোলিয়া, চীনের উত্তরাঞ্চল ও তিব্বতে প্রজনন করে। সচরাচর মাটির ওপর অনেক পাখি একসঙ্গে কলোনি করে থাকে। শুকনো ঘাস-লতা ও দেহের ঝরা পালক দিয়ে মাটিতে বাসা বানায়। স্ত্রী দুই থেকে চারটি ঘিয়ে রঙের ডিম পাড়ে, যার ওপর থাকে কালো, খয়েরি বা ধূসর ছিটছোপ। ডিম ফোটে ২৫ দিনে। সদ্য ফোটা বাচ্চার কোমল পালকের রং ঘিয়ে-হলুদ বা রুপালি-সাদা। বাচ্চারা প্রায় পাঁচ দিনে বাসা ছাড়ে এবং চার-পাঁচ বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয়।