১৮৯০ সালে প্রসন্ন কুমার সেনের নির্মিত এই বাড়িটি চট্টগ্রামের সবচেয়ে উঁচু ভবন ছিল
পি কে সেন ভবন কি হারিয়ে যাবে?

চারদিকে টিনের ঘেরা দেওয়া। ভাঙার কাজ শুরু হবে আর কয়েক দিন পরে। পি কে সেন ভবনে ঢুকতেই তাই দীর্ঘশ্বাসটা যেন টের পাওয়া গেল। প্রশস্ত আঙিনায় প্রতি বছর মহা ধুমধাম করে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এখন চত্বরটা নীরব, সুনসান। মাঝের আধাতলার গোল ভেন্টিলেটর দিয়ে আসা বিকেলের আলোয় আলোকিত সিঁড়িঘর। প্রতি তলায় দুদিকে দুটো সিঁড়ি উঠে গেছে। একটা অভ্যাগতদের, অন্যটা বাড়ির বাসিন্দাদের জন্য। চুন-সুড়কির রেলিংটা কারুকাজ করা।
দোতলায় বাড়ির মালিকের দরজা হাট করে খোলা। ঢুকতেই একটা চতুর্ভুজ আকৃতির আসবাবহীন ঘর। এ ঘরের ডান–বাম দুদিকে দুটো প্যাসেজ। কড়া নাড়তেই এগিয়ে এলেন একজন। জানতে চাইলাম, বাড়িটা কবে নাগাদ ফেলা ভেঙে হবে। উত্তর না দিয়ে তিনি ভেতরে যেতে অনুরোধ করেন। বললেন, ‘ঘুরে দেখুন, কী হাল বাড়িটার। আমরা এর মধ্যে বড় ভয়ে ভয়ে থাকি। সবাই ঐতিহ্যের কথা বলে। কিন্তু আমরা প্রাণ বাঁচাব কীভাবে?’
জানালেন, তিনি বাড়ির অন্যতম মালিক অনুপম ঘোষ। দোতলার চক্রকার বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনুপমের কথার সত্যতা মিলল। কোথাও মেঝেতে ফাটল ধরেছে। কোথাও দেয়াল থেকে উঠে এসেছে পলেস্তারা। রেলিংয়ের একটা অংশ খসে পড়েছে। সেখানে লাল পতাকা লাগানো।
কয়েক দিন আগে সিটি করপোরেশন থেকে ম্যাজিস্ট্রেট এসে জানিয়ে দিয়ে গেছেন বাড়ি ঝঁুকিপূর্ণ, এখানে থাকা নিরাপদ নয়। তাঁরা যেন নিজ উদ্যোগে বাড়িটি ভেঙে ফেলেন। তাই বাড়ির মালিকেরা ভাড়াটেদের নোটিশ দিয়েছেন ঘর ছাড়ার। বাড়ির বাসিন্দা জয়তু ঘোষের কাছ থেকে জানা গেল এই তথ্য। তিনি বললেন, সংস্কারের খরচ নতুন বাড়ি নির্মাণের চেয়েও বেশি। তাই একটি আবাসন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছেন বাড়ির মালিকেরা।
আলাপের ফাঁকে ফাঁকে এঘর, সেঘর, দোতলা, তিনতলা, ছাদের গম্বুজ অবধি ঘুরে দেখা হয়। ১৩৩ বছরের ভবনটিতে পা ফেলতে হচ্ছিল সাবধানে। সবকিছুই নড়বড়ে। এখানে-ওখানে ক্ষয়ে গেছে। তবু প্রতিটি দরজার ওপর লতাপাতার মোটিফ, ষড়ভূজ ও চতুর্ভুজ আকৃতির কক্ষ। পিরামিডের মতো নিচ থেকে ওপরের দিকে ক্রমশ ঘরের সংখ্যা কমে গিয়ে বেড়েছে খোলা জায়গা। সব মিলিয়ে প্রশান্ত এক অনুভূতি ভর করে মনে। অথচ আর কয়েক মাস মাত্র আয়ু এই ভবনের! বাড়ির আরেক মালিক বাবলা ঘোষ জানালেন বাবা, সুশীল কুমার ঘোষের সঙ্গে এ বাড়িতে এসেছিলেন চার-পাঁচ বছর বয়সে। তাঁর কথা, ‘সংরক্ষণের কথা বলে সবাই, কিন্তু কে সংরক্ষণ করবে? গত প েবছর ধরে সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বেশ কয়েকটি সংস্থার কাছে আবেদন করেও কোনো সাড়া পাইনি।’
১৮৯০ সালে প্রসন্ন কুমার সেনের নির্মিত এই বাড়িটি চট্টগ্রামের সবচেয়ে উঁচু ভবন ছিল এক সময়। এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ শামসুল হোসাইন বলেন, এমন উঁচু ভবন তদানীন্তন অভিভক্ত বাংলার কলকাতা বা ঢাকায়ও ছিল না। কেবল তা–ই নয়, এই ভবনটি নির্মিত হয়েছে ঔপনিবেশিক এবং সনাতন হিন্দু স্থাপত্যরীতি মেনে।
দেশভাগের পর প্রসন্ন কুমার ভারতে চলে গেলে ১৯৫০ সালে সুশীল কুমার ঘোষ বাড়িটি কিনে নেন। নতুন মালিকেরা বাড়িটির চেহারায় কোনো পরিবর্তন অনেননি। এটির স্থাপত্য রীতিও তাই অবিকৃত থেকে গেছে।
স্থপতি জেরিনা হোসেনের মতে, এমন স্থাপত্যে গড়া ভবন কেবল চট্টগ্রামে নয়, বাংলাদেশেই বিরল। এখানে মোগল ও সনাতন বাঙালি রীতির মিশেল ঘটেছে। চট্টগ্রামের ‘ল্যান্ডমার্ক’ও এটি। ভবনটি ভেঙে ফেলার বিষয় উত্থাপন করতেই জেরিনা প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামের বিশদ নগর পরিকল্পনায় ভবনটিকে নগরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। এখন সরকারের উচিত ভবনমালিকদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে এটি সংস্কার ও রক্ষায় এগিয়ে আসা।
সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ভবন ভাঙার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল িক? সংস্থাটির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজিয়া শিরিনকে প্রশ্ন করলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা ভবনটি ভেঙে ফেলতে বলিনি, সংস্কার করতে বলেছি। ঝঁুকির কথা বিবেচনা করে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যেতে পরামর্শ দিয়েছি।’
এদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বলছে নতুন ভবন নির্মাণে অনুমতি দেয়নি তারা। সিডিএর উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা পি কে সেন ভবন ভাঙার অনুমতি দিইনি। নতুন কোনো ভবনের নকশাও অনুমোদন দেওয়া হবে না।’
তবে কে করবে সংস্কার? ১১৩ বছরের এই পুরোনো ভবনটি এখনো তো সংরক্ষণযোগ্য হিসেবে তালিকাভুক্তই করেনি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ। বিভাগের সহকারী পরিচালক লাভলি ইয়াসমিন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী ১৫০ বছরের পুরোনো ভবনগুলোই সংরক্ষণের আওতায় আসে। তবে ঐতিহ্যের দিকটি বিবেচনা করে আরও কম বয়সী ভবনও আমরা সংরক্ষণ করেছি। বরিশালের কালেকটরেট ভবন এর উদাহরণ। সরকার অনুমতি দিলে আমরা এই ভবনটিও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেব।’ পি কে সেন ভবনের পাঁচতলায় রেলিং ঘেরা প্রশস্ত আঙিনার ঠিক মাঝখানে প্রার্থনা ঘর। এখানে দাঁড়ালে চোখে পড়ে কর্ণফুলী নদী। শৌখিন পি কে সেন এখানে নদীর তাজা হাওয়ায় বসে বাঁশি বাজাতেন বলে জানালেন বাড়ির বাসিন্দা অর্পণ ঘোষ। এই বাড়িতে শৈশব, কৈশোর কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণটির। এমন মায়াময় স্থান ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে না? প্রশ্ন করতে মাথা নাড়েন তিনি। কণ্ঠে বিষাদের সুর। বলেন, ‘এ ছাড়া আর উপায় কী বলুন?’