পূজার আনন্দ বিবর্ণ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়

সারা দেশে পূজামণ্ডপে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধনফাইল ছবি

দুই মাস বন্ধ থাকার পর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীর রাধামাধব জিউ মন্দিরে ফের পূজা–অর্চনা শুরু হয়েছে ১৫ ডিসেম্বর। গত ১৫ অক্টোবর এ মন্দিরের সব বিগ্রহ ভেঙে ফেলে হামলাকারীরা। সেসব আর প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।

সংখ্যালঘুদের সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নোয়াখালীর আহ্বায়ক বিনয় কিশোর রায় বলছিলেন, ‘এভাবে আরাধনাবিহীন দেবালয় আর কত দিন ফেলে রাখা যায়? তাই পূজা শুরু হয়েছে। মন্দিরের বিগ্রহগুলো ছিল বেশ দামি। সেগুলো ভারত থেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু এখন নতুন করে বিগ্রহ নির্মাণ বা সংগ্রহ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষ।’

শুধু এই রাধামাধব জিউ মন্দির নয়, গেল দুর্গাপূজার দশমীর দিন চৌমুহনীতে মোট আটটি মন্দির ও সাতটি পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলে এই হামলা। এ সময় নিহত হন ইসকনের দুই ভক্ত যতন সাহা ও প্রান্ত চন্দ্র দাস।

আসকের তথ্যমতে, এ ঘটনাসহ শুধু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে হিন্দুদের বাড়িঘরে ১০২টি হামলার ঘটনা ঘটে। কোভিডকালে ২০২০ সালেও হিন্দুদের ১২টি বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়, ৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৬৭টি মন্দির-উপাসনালয়ে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। এসব ঘটনায় আহত হন ৭১ জন।

দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন কুমিল্লা থেকে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক হামলা। অন্তত পাঁচ দিন ধরে দেশের ১৮টি জেলায় এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এসব হামলায় নিহত হন নয়জন। ধ্বংস হয় কয়েক শ মন্দির।

সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে দুর্গাপূজার সময় এমন ব্যাপক আকারে হামলার ঘটনা আগে দেখা যায়নি। বর্ষীয়ান রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুজোর সময় এই আকারে হামলা ব্রিটিশ আমলে হয়েছে শুনিনি, পাকিস্তান আমলে দেখিনি, স্বাধীন বাংলাদেশেও এর নজির নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যখন ক্ষমতায়, তখন এ সাম্প্রদায়িক হামলা ন্যক্কারজনক।’

এই ধারাবাহিক হামলা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ বলে অভিযোগ করেন সংখ্যালঘু নেতারা। হামলা ঠেকাতে শাসক দল আওয়ামী লীগের কার্যকর ভূমিকারও সমালোচনা ওঠে সংখ্যালঘুসহ সুশীল সমাজের নানা পক্ষ থেকে।
অষ্টমীর দিনে বিসর্জন, কুমিল্লা থেকেই শুরু

দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের নানুয়ার দীঘি পূজামণ্ডপে পবিত্র ‘কোরআন অবমাননার’ অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় উসকানিমূলক প্রচারণা চালানো হয়। একপর্যায়ে অষ্টমীর দিনই দশমীর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সেখানকার দুর্গাপূজা শেষ করা হয়। এ সময় জেলার কয়েকটি পূজামণ্ডপ ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। এর জের ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নানা উসকানিমূলক অপপ্রচারের মাধ্যমে সারা দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কুমিল্লার ঘটনার পরেই চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফেনী, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, মুন্সিগঞ্জ, হবিগঞ্জ, বরিশালসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় পূজামণ্ডপ ও মন্দিরের প্রতিমা, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও দোকানপাটে তাণ্ডব চালানো হয়। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পূজামণ্ডপে ও মন্দিরে হামলার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন। ১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৫টি পরিবারের ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়। অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরের পাশাপাশি চালানো হয় লুটপাট।

নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা
ফাইল ছবি

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ১৩ থেকে ২০ অক্টোবর দেশের ১৮টি জেলায় সহিংসতায় সাতজন নিহত হয়। প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে ৭২টি, বাড়িঘরে হামলা হয়েছে ৭৭টি। তবে ঐক্য পরিষদের হিসাবে মৃত্যু, আহত ও লুটপাটের সংখ্যা আরও বেশি।

কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগে প্রধান অভিযুক্ত ইকবালকে ২১ অক্টোবর কক্সবাজার থেকে আটক করা হয়। ইকবাল এখন কুমিল্লার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। এ ঘটনায় কুমিল্লায় মোট ১৩টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১০৭ জন। নোয়াখালীতে পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় সর্বমোট ৩২টি মামলা হয়েছে। এজাহারে থাকা আসামির সংখ্যা ৪১২ জন। আর সন্দিগ্ধের সংখ্যা আট থেকে নয় হাজার। এ পর্যন্ত মোট ২৩৫ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন এ ঘটনায়। চাঁদপুরের জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, মোট ১১টি মামলা হয়েছে এ জেলায়।

ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পীরগঞ্জে জেলেপল্লিতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা
ছবি: সংগৃহীত

পীরগঞ্জে জেলেপাড়ায় ‘মনের ভয় কাটে নাই’

কুমিল্লার ঘটনার পর দেশে যখন সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেই চলেছে, তখন ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ১৭ অক্টোবর রাতে রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নে মাঝিপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়। ভাঙচুর, লুটপাটের পাশাপাশি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে নিঃস্ব হয় অনেক পরিবার। এখন পালা করে দিনে–রাতে পুলিশ পাহারা থাকে এ গ্রামে।

গ্রামের বাসিন্দা নন্দ রানী বলেন, ‘অ্যালা তো (এখন) হিন্দু-মুসলমান সবায় সবার সাথে কথা কওচি (বলছি)। কিছু সাহায্য পাচি। যার যেটা কাম কাজ করোচি খাওচি সমস্যা নাই। কিন্তুক মনের ভয়টা কাটে নাই।’

জেলেপল্লিতে হামলার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে চারটি। এর মধ্যে একটি মামলা হয়েছে জেলেদের ঘরবাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগে। অন্য তিনটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।

ওই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুবুর রহমান জানান, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭২ জনকে। এর মধ্যে আদালতে ৭ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সব কিছু পুড়ে শেষ। তছনছ হয়েছে সংসার। গতকাল রাতের হামলা–সহিংসতার কথা মনে করে কান্না থামাতে পারছেন না রংপুরের পীরগঞ্জের বড়করিমপুর এলাকার এই নারী
ফাইল ছবি

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি, ক্ষতে ‘নতুন আঘাত’

সাম্প্রদায়িক হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ২৮ অক্টোবর একটি বিবৃতি দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, দেশে সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় একটি মন্দিরেও অগ্নিসংযোগ কিংবা ধ্বংস করা হয়নি। ধর্মীয় সহিংসতায় এখন পর্যন্ত মাত্র ছয়জন মারা গেছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন মুসলমান, আর তাঁরা হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার চেষ্টার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন। দুজন হিন্দু মারা যান, তাঁদের মধ্যে একজনের সাধারণ মৃত্যু হয়েছে। অন্যজন ডুবে মারা গেছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সংগঠন ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য আমাদের স্তম্ভিত করেছে। এই অস্বীকারের ঘটনা ক্ষতে নতুন করে আঘাত দেওয়ার শামিল।’

বিচারিক তদন্তের নির্দেশ, পরে স্থগিত

দুর্গাপূজার উৎসব চলাকালে ছয় জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা রোধে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে গত ২১ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনুপ কুমার সাহা ও মিন্টু চন্দ্র দাস হাইকোর্টে রিট করেন। এতে হামলার ঘটনাসংশ্লিষ্ট চিফ মেট্রোপলিটন বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা চাওয়া হয়।

রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২৮ অক্টোবর হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। ছয়টি জেলা হচ্ছে কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও রংপুর। সংশ্লিষ্ট চিফ মেট্রোপলিটন বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল হাইকোর্টের আদেশে।

২১ ডিসেম্বর সহিংস হামলার ঘটনায় বিচারিক তদন্ত করতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত করেন চেম্বার বিচারপতি।

৯ বছরে সংখ্যালঘুদের ওপর সাড়ে ৩ হাজার হামলা

গত ১৭ মার্চ হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বক্তব্যের সমালোচনা করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ঝুমন দাশকে ১৬ মার্চ রাতেই আটক করে পুলিশ। ৬ মাস ১২ দিন কারাবাসের পর ঝুমন মুক্ত হন।

আসকের তথ্যমতে, এ ঘটনাসহ শুধু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে হিন্দুদের বাড়িঘরে ১০২টি হামলার ঘটনা ঘটে। কোভিডকালে ২০২০ সালেও হিন্দুদের ১২টি বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়, ৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৬৭টি মন্দির-উপাসনালয়ে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। এসব ঘটনায় আহত হন ৭১ জন।

আসক বলেছে, ২০১৩ সাল থেকে গত ৯ বছরে সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ৩ হাজার ৬৫৮টি হামলার ঘটনা ঘটে। বছরগুলোতে শুধু মন্দির ও উপাসনালয়ে হামলা এবং প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে ১ হাজার ৬৭৮টি। হামলার শিকার প্রায় ৯৯ শতাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিচারে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার পুজোর সময় যে ধারাবাহিক হামলা হলো, তা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। সরকার পরিচালনার ভার যাঁদের হাতে, তাঁরা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আগের হামলাগুলোর বিচার না হওয়ায় এসব ঘটনা ঘটছে।’