প্রতি ১০ জনে ১ জন প্রতারণার শিকার

পিআরআইয়ের জরিপ বলছে, প্রতারকের কবলে পড়ে একেকজন গ্রাহক গড়ে ৯,২১৯ টাকা টাকা খুইয়েছেন।

মোস্তাফা জব্বার

দেশে মুঠোফোনে অর্থ লেনদেন করতে গিয়ে প্রতি ১০ জন গ্রাহকের ১ জন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। প্রতিটি প্রতারণার ঘটনায় একেকজনকে খোয়াতে হয়েছে গড়ে ৯ হাজার ২১৯ টাকা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এক জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল বুধবার ‘ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সেবায় ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এই জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়।

দেশে এখন মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৪টি। এর মধ্যে বিকাশ, নগদ, রকেট, এম ক্যাশ, শিওর ক্যাশ, উপায়, ট্যাপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকসংখ্যায় এগিয়ে। তাদের গ্রাহক ও লেনদেন বাড়ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মুঠোফোনে আর্থিক সেবার গ্রাহক ও লেনদেন ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আনার বড় মাধ্যম হবে এই এমএফএস। আগামী দিনগুলোতে মানুষ বাজার করা থেকে শুধু করে কেনাকাটা, ভাড়া পরিশোধ, বিল দেওয়া, বিমার প্রিমিয়াম দেওয়া, অল্প পরিমাণে ঋণ নেওয়া—মোটামুটি সব লেনদেনই করবে মুঠোফোনের মাধ্যমে।

সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রায় সব ভাতা ও শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা এখন মুঠোফোনেই পাঠানো হয়। করোনাকালে নিম্ন আয়ের মানুষকে সরকার নগদ সহায়তা দিয়েছে এই এমএফএস ব্যবহার করে। সব মিলিয়ে সেবার পরিসর দিন দিন বাড়ছে। তাই এ খাতে প্রতারণা ঠেকাতে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

জরিপের ফলাফল তুলে ধরার অনুষ্ঠানে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, যে মানুষগুলো ব্যাংকে যেতে পারেননি, তাঁদের কাছে মুঠোফোনে আর্থিক সেবা পৌঁছে গেছে। তাঁরা এখন মুঠোফোনের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারছেন। অথচ তাঁদের অনেকে জীবনে কোনো দিন ব্যাংকের শাখা দেখেননি। তিনি বলেন, ‘আপনি যত বেশি ডিজিটাল হবেন, অপরাধও ডিজিটাল হবে। প্রতারণা হলে সব দায় অপারেটরদের দিয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড় করানো অন্যায়।’

মন্ত্রী প্রতারণা ঠেকাতে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

প্রতারণার ধরন

পিআরআই জরিপটি করেছে দেশের ৪৫টি জেলার ৩০০ উপজেলার মোট ৭ হাজার ২৭৯ নারী-পুরুষ এবং সেবাদাতার প্রতিনিধি বা এজেন্টের মতামত নিয়ে। গত বছরের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মাঠপর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপটি করেছেন পিআরআইয়ের অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান।

জরিপে দেখা যায়, গ্রাহক উত্তরদাতাদের ৫৫ শতাংশ জানিয়েছেন যে তাঁরা মুঠোফোন ব্যবহার করে লেনদেন করেন। তাঁরা নানাভাবে প্রতারণার শিকার হন। সাধারণত ছলাকলা বা মিথ্যা কথা বলে গোপন নম্বর (পিন) নিয়ে নেয় প্রতারকেরা। আবার ই-মেইলসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারক গ্রাহকের হিসাবের নিয়ন্ত্রণ (হ্যাকড) নিয়ে নেয়। প্রতারণার আরও দুটি বড় ধরন হলো, জিনিসপত্র বিক্রির কথা বলে অগ্রিম টাকা নেওয়া এবং বিভিন্ন ধরনের সেবামাশুলের কথা বলে টাকা নেওয়া।

আপনি যত বেশি ডিজিটাল হবেন, অপরাধও ডিজিটাল হবে। প্রতারণা হলে সব দায় অপারেটরদের দিয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড় করানো অন্যায়।
মোস্তাফা জব্বার টেলিযোগাযোগমন্ত্রী

জরিপ অনুযায়ী, প্রতারণার একেকটি ঘটনায় গ্রাহকেরা দেড় থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খুইয়েছেন। প্রতারণার শিকার একজন নারী গ্রাহক গড়ে ৯ হাজার ১৫৯ টাকা খুইয়েছেন। পুরুষের ক্ষেত্রে পরিমাণটি ৮ হাজার ৭৮২ টাকা।

জরিপে কোন এলাকার মানুষ বেশি প্রতারণার শিকার হন, সেটাও উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, সিলেট বিভাগের গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হওয়ার হারটি বেশি, ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে কম ঢাকা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগে। এই তিন বিভাগে হার ৬ শতাংশ।

সমাধান হলে গ্রাহক টিকে থাকে

জরিপে উঠে এসেছে, প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের দুই-তৃতীয়াংশ বলেছেন, তাঁরা অভিযোগের সমাধান পেয়েছেন। এক-তৃতীয়াংশের দাবি, অভিযোগের কোনো সমাধান হয় না।

অবশ্য দেখা যাচ্ছে, যেসব সেবাদাতা নিয়মিত অভিযোগের সুরাহা করে, তাদের ক্ষেত্রে গ্রাহক ধরে রাখার হার বেশি। জরিপে উঠে এসেছে, প্রতারণার শিকার হয়ে এক দিনের মধ্যে প্রতিকার পেলে ৯৬ শতাংশ গ্রাহকই ওই অপারেটরে (এমএফএস অপারেটর) থেকে গেছেন। সাত দিনে প্রতিকার পেলে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক অপারেটর পরিবর্তন করেননি। ১৫ দিনে প্রতিকার পেলে ৫৭ শতাংশ গ্রাহক আগের অপারেটরের সেবা গ্রহণ করেন। আর প্রতিকার না পেলে অপারেটর পরিবর্তন করে ফেলেন প্রতারিত গ্রাহক।

খাতটি কত বড়

২০১১ সালে বাংলাদেশে প্রথম এমএফএস চালু হয়। এরপর থেকে প্রতিবছরই লেনদেন বেড়েছে। ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা বিপুলসংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষ নিজেদের মুঠোফোন বা এজেন্টের মাধ্যমে এই সেবা নেন। যেমন একজন রিকশাচালক বা গৃহকর্মী মুহূর্তেই গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা পাঠিয়ে দিতে পারেন। এ ছাড়া মধ্যবিত্তরা সন্তানের স্কুলের বেতন, কেনাকাটাসহ বিভিন্ন কাজে অর্থ পরিশোধে এমএফএস ব্যবহার করেন।

পিআরআইয়ের জরিপে বলা হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেন হয়েছে সব মিলিয়ে ৭৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। শুধু জানুয়ারি মাসেই ৩৪ কোটি ৯৪ লাখ লেনদেন হয়েছে। ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় বার্ষিক লেনদেন ২৮ শতাংশ বেড়েছে। জরিপের আওতায় আসা নারী-পুরুষদের ৮৭ শতাংশ বিকাশ, ৪১ শতাংশ নগদ, ১৫ শতাংশ রকেট এবং ৪ শতাংশ শিওর ক্যাশের গ্রাহক।

‘মনোবিদও নিয়োগ দিয়েছি’

জরিপের ফলাফল তুলে ধরার অনুষ্ঠানে বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদির বলেন, অনেক গ্রাহক জানেন না কীভাবে এ ধরনের সেবা সঠিকভাবে গ্রহণ করতে হয়। প্রতারকেরা কথার মারপ্যাঁচে ফেলে ছলাকলা করে গ্রাহকদের টাকা নিয়ে নেয়। গ্রাহকদের সচেতন করতে হবে। প্রতারণা ঠেকাতে বিকাশ স্বপ্রণোদিতভাবে নানান কর্মসূচি নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ই-কমার্সের ক্ষেত্রেও বিকাশ কঠোর হয়েছে। কেন প্রতারণা করা হয়, তা জানতে ও বুঝতে মনোবিদও নিয়োগ দিয়েছে। গ্রাহকেরা যখন প্রতারণার শিকার হন, তিনি প্রলুব্ধ হওয়ার কথা শিকার করেন না।

কামাল কাদির মনে করেন, এ ধরনের প্রতারণা পুরো মুঠোফোনে আর্থিক সেবা খাতের সমস্যা। তাই দায়িত্ব শুধু বিকাশের ওপর দিলে হবে না। তিনি বলেন, অন্যরা যদি বালুতে মুখ গুঁজে বলে বিকাশ এই খাতের নেতৃত্বে আছে, বিকাশ যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে সবাই সুবিধা পাবে, আসলে তা ঠিক নয়।

এসবিকে টেক ভেঞ্চারস ও এসবিকে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোনিয়া বশির কবির বলেন, শুধু এমএফএস অপারেটর নয়, এ ধরনের লেনদেনের পেছনে ব্যাংকের মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানও আছে। এক লাখ টাকার প্রতারণা হলে ওই টাকা তো ব্যাংকের মাধ্যমেই গেছে। তাহলে তাদেরও দায় আছে।

সবশেষে অনুষ্ঠানে সভাপতি ও পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, মুঠোফোনে আর্থিক সেবা গ্রহণকারীদের অনেকে সঠিকভাবে সেবা নেওয়ার প্রক্রিয়া জানেন না বলেই প্রতারণার শিকার হন। তাঁদের সচেতন করতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার, উন্নয়ন সমুন্নয়ের ইমেরিটাস ফেলো খন্দকার সাখাওয়াত আলী, ফ্রেডরিক নুম্যান স্টিফটাং ফার দি ফ্রেইহেইটের বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার কান্ট্রি ডিরেক্টর ওলফগং হেঞ্জ, ই-ক্যাবের সহসভাপতি এম শাহাব উদ্দিন প্রমুখ।