করোনায় প্রথম ২ হাজার মৃত্যু ১২০ দিনে, পরের ২ হাজার ৫১ দিনে

প্রতীকী ছবি

আগস্টের শুরুর দিকে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দৈনিক মৃত্যু কিছুটা কমে আসে।গত কিছুদিন ধরে এটি আবার বাড়ছে। ইতিমধ্যেই ৪ হাজার ছাড়িয়েছে মৃত্যুর সংখ্যা। দেশে করোনা সংক্রমণের প্রথম ১২০ দিনে ২ হাজার পার হয় করোনায় মৃত্যু। আর শেষ ২ হাজার পার হয় ৫১ দিনে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে জুলাইয়ে।

করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এমনটাই দেখা গেছে। দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। আর প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। আজ মঙ্গলবার মারা গেছেন ৪৫ জন। দিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জন মারা গেছেন গত ৩০ জুন। বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমিত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যুর দিক থেকে ২৯তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। যদিও সংক্রমণের দিক থেকে অবস্থান ১৫তম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সংক্রমণের ৪৪তম দিনে শতক পার হয় করোনায় মৃতের সংখ্যা। আর ৭৯তম দিনে ৫০০ ছাড়িয়ে যায়। এরপর এটি দ্রুত বাড়তে থাকে। ৯৫তম দিনে হাজার পার হয়। তার মানে দ্বিতীয় ৫০০ মৃত্যু হতে সময় লাগে ১৬ দিন। এরপর ১২ দিনে আরও ৫০০ মানুষ যুক্ত হয় করোনায় মৃত্যুর মিছিলে। সবশেষ ১৩ দিনেও ৫০০ ছাড়িয়েছে মৃত্যুর সংখ্যা।

যথা সময়ে চিকিৎসা দিতে না পারায় মৃত্যু বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অনেক দেশের তুলনায় দেশে মৃত্যুহার এখনো কম আছে। যদিও মৃত্যুহার আগের চেয়ে বাড়ছে। দেশে এখন শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুহার ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বিভিন্ন অসংক্রামক ব্যাধিতে ভোগা রোগী ও বয়স্করা আগের চেয়ে বেশি হারে আক্রান্ত হওয়ায় মৃত্যু বাড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে বিশ্বে করোনায় গড় মৃত্যুহার প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ।ইউরোপের কয়েকটি দেশে এটি ১৪ শতাংশও ছাড়িয়েছে। ভারতেও এটি ২ শতাংশের বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, মার্চে সব মিলে করোনায় মারা যান মাত্র ৫ জন। এপ্রিলে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৩ জনে। এরপর মে মাসে মারা যান ৪৮২ জন। আর জুনে মারা গেছেন ১ হাজার ১৯৭ জন। জুলাইয়ে এটি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৬৪ জনে। জুনে প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৪০ জনের আর জুলাইয়ে ৪১ জনের। আগস্টে আজ পর্যন্ত মারা গেছেন ৯১৭ জন। চলতি মাসে দিনে গড়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৭ জনের।

অধিকাংশ দেশেই মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসছে। করোনাভাইরাস নিয়ে নিয়মিত তথ্য প্রদানকারী যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তথ্য বলছে, বিশ্বে একদিনে সাড়ে ৮ হাজার মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে এপ্রিলে। ওই সময় দিনে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। এখন দিনে ২ লাখের বেশি শনাক্ত হচ্ছে। কিন্তু মৃত্যু আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। দিনে মৃত্যু এখন চার থেকে সাড়ে হাজারে নেমে এসেছে।

করোনায় মৃতের ৭৯ শতাংশ পুরুষ:

জাতিসংঘের নারী উন্নয়ন তহবিল ইউএন উইমেন বলছে, সব দেশেই করোনা আক্রান্ত হয়ে নারীর তুলনায় পুরুষ বেশি হারে মারা গেছেন। জার্মানিতে পুরুষ মৃত্যুর হার ৫৫ এবং নারী ৪৫ শতাংশ। ইতালিতে ৫৮ শতাংশ পুরুষ ও ৪২ শতাংশ নারী মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ৫৪ শতাংশ পুরুষ ও ৪৬ শতাংশ নারী মারা গেছেন। আর করোনা শুরুর দেশ চীনে ৬৩ শতাংশ পুরুষ ৩৭ শতাংশ নারী মারা গেছেন। এ ছাড়া করোনায় মৃতদের মধ্যে ভারতে ৬৩ শতাংশ ও পাকিস্তানে ৭১ শতাংশ পুরুষ।

সরকারি তথ্য বলছে, দেশে করোনায় ‍মৃতের ৭৯ শতাংশ পুরুষ ও ২১ শতাংশ নারী। এ পর্যন্ত দেশে ৩ হাজার ১৬৯ জন পুরুষ ও ৮৫৯ জন নারী মারা গেছেন করোনা আক্রান্ত হয়ে। তবে এর বাইরে করোনার উপসর্গ নিয়ে আরও অনেকের মৃত্যু ঘটলেও তার কোনো সরকারি হিসাব নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের প্রকল্প বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও) বলছে, গত ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ১১০ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনার উপসর্গ নিয়ে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, জিনগতভাবে নারীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হয়ে থাকে। এ ছাড়া নারীর তুলনায় পুরুষেরা বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে ভোগেন। ধূমপান, মদ্যপানের মতো ক্ষতিকর জিনিসে নারীর তুলনায় পুরুষের অভ্যস্ততা বেশি। সামাজিক দূরত্ব রক্ষা না করার প্রবণতাও বেশি পুরুষের। এসব কারণে নারীর তুলনায় পুরুষের মৃত্যুহার বেশি।

মৃতের প্রায় অর্ধেক ঢাকা বিভাগে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, করোনায় মোট মৃতের প্রায় অর্ধেক ঢাকা বিভাগে। ৪৮ শতাংশ মারা গেছেন এ বিভাগে। এরপর সবচেয়ে বেশি ২২ শতাংশ মৃত্যু চট্টগ্রামে। এর বাইরে খুলনায় ৮ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭ শতাংশ, সিলেটে ৫, বরিশালে ও রংপুরে ৪ শতাংশ হারে এবং ময়মনসিংহে ২ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে।

তবে বিপিও বলছে, করোনায় উপসর্গে মৃতের এক-তৃতীয়াংশ চট্টগ্রাম বিভাগে। উপসর্গ নিয়ে এ বিভাগে মারা গেছেন ৭০৪ জন।

৭৭ শতাংশের বয়স ৫০ বছরের বেশি

দেশে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৭ শতাংশের বয়স ৫০ বছরের বেশি।এর মধ্যে ৬০ বছরের বেশি বয়সী আছে ৪৯ শতাংশ আর ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী ২৮ শতাংশ।৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ১৩ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ৬ শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ২ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী ১ শতাংশ।বাকিদের বয়স ১০ বছরের কম।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ইউরোপ ও আমেরিকায়।অথচ সেখানকার চিত্র বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন।পাশের দেশ ভারতেও একই অবস্থা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা বলছে, ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে ৯৫ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের বেশি।আর সুইডেনে ৯৬ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর কন্ট্রোল ডিজিজ অ্যান্ড প্রিভেনশন সেন্টার (সিডিসি) বলছে, দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি।আর ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে, করোনায় মৃতদের প্রায় ৬০ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের বেশি।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, দেশে ৫০ বছর পার হলেই নানা অসংক্রামক ব্যাধিতে ভুগতে থাকেন অনেকে। তাই ইউরোপ-আমেরিকায় ৭০-৮০ বছর পার হলে যে ঝুঁকি, এখানে ৫০ পার হলেই সেই ঝুঁকি। আবার দেশে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার চর্চা নেই।তাই অনেকেই নিজের রোগ সম্পর্কে জানেন না। করোনায় মৃতের ক্ষেত্রে রোগীর অন্য রোগের প্রভাব থাকে। কয়েকটি শিশুও মারা গেছে দেশে, যাদের অসংক্রামক ব্যাধি ছিল।