প্রশিক্ষণ দিয়েই দায়িত্ব শেষ

রাজধানীর রাজারবাগে থাকেন নিপা। তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। সম্প্রতি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেয় অটিস্টিক সন্তানটি। তার প্রশিক্ষণ কতটা কাজে লেগেছে, জানতে চাইলে নিপা বললেন, ‘দিনে শ খানেক টাকা পাওয়া যায়, খাওয়া পাওয়া যায়, এটাই লাভ।’

এই নারী এবং আরও কয়েকজন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রশিক্ষণ কার্যত তাঁদের কোনো কাজে আসছে না। প্রশিক্ষণের জ্ঞান কাজে লাগানোর মতো আর্থিক সংগতিও নেই অনেকের। মন্ত্রণালয়ও প্রশিক্ষণ দিয়েই যেন দায় সারছে। উপকারভোগীর জীবনমান উন্নয়নে প্রশিক্ষণ কোনো ভূমিকা রাখছে কি না, সেই হিসাবও নেই তাদের কাছে। কর্মসূচিগুলো নিয়ে আছে দুর্নীতির অভিযোগও। উপকারভোগীদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে কর্মসূচিগুলো নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ আছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ রকম ২৯টি কর্মসূচির অর্থ বরাদ্দ এসেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নারী উদ্যাক্তা উন্নয়ন তহবিল ও শিশু উন্নয়ন তহবিলের ১০০ কোটি টাকা থেকে। এর মধ্যে ২১টি কর্মসূচি চলমান। নতুন অনুমোদন করা হয়েছে ৮টি। চলমান কর্মসূচিগুলোর বেশির ভাগের মেয়াদ ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত। তবে করোনা পরিস্থিতিতে কোনো কোনোটির মেয়াদ এক বছর করে বাড়ানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের হয়ে কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। কর্মসূচিগুলোর কোনোটির বাজেট ১০ কোটি টাকা অতিক্রম করেনি।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বাজেট ও অডিট অধিশাখা) মোসা. ফেরদৌসী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করতে চাইলে প্রশিক্ষণের বিষয়টিই প্রথমে আসে। তাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। পাশাপাশি উদ্যোক্তাও তৈরি করা হচ্ছে।’

কিন্তু এসব প্রশিক্ষণ কর্মসূচির অভিজ্ঞতা উপকারভোগীদের কতটা কাজে লাগছে সে তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে। এ বিষয়ে ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘এটা জরিপ করা হয় না।’

■ অর্থ বরাদ্দ এসেছে ২৯টি কর্মসূচির জন্য। ■ ২১টি কর্মসূচি চলছে, বেশির ভাগের মেয়াদ ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত। ■ তবে করোনা পরিস্থিতিতে কোনোটির মেয়াদ এক বছর করে বাড়ানো হয়েছে। ■ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা। কোনোটির বাজেট ১০ কোটি টাকা অতিক্রম করেনি।

‘কোনো আশা দেন না কেউ’

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও নারীদের জন্য পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে রাজারবাগের একটি মেয়েশিশু। হাজারীবাগে প্রশিক্ষণ চলাকালে দেখা হয়েছিল তার মা নিপার সঙ্গে। প্রশিক্ষণে মেয়ে কী শিখেছে জানতে চাইলে নিপা বলেন, হাজারীবাগে তাঁর মেয়ে ৭ দিনের প্রশিক্ষণে ডিমের খোসা, কাগজ দিয়ে শোপিস বানানো শিখেছে। এর আগে মিরপুরে তিন দিনের প্রশিক্ষণে অংশ নেয় তাঁর মেয়ে। মেয়েটা ব্যাগ বানাতে পারে। প্রশিক্ষণে গিয়ে মেয়ের তৈরি ব্যাগ বিক্রিতে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা চান। কিন্তু কেউ কোনো আশা দিতে পারেন না।

এলাকাভিত্তিক নারী ও শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের হয়ে কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করছে ডেটা কনসালট্যান্ট বাংলাদেশ লিমিটেড।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কর্মসূচির তথ্যে বলা হয়, ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ের কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরে ১৫ হাজার ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ৯ হাজার ৬৫০ জনের প্রশিক্ষণ শেষ।

এ কর্মসূচির মধ্যে পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা আছে কি না, জানতে চাইলে ডেটা কনসালট্যান্ট বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মারুফ আহমেদ বলেন, ‘না। আমরা একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দিয়ে পুনর্বাসনের সুপারিশ করব।’

প্রশিক্ষণের জ্ঞান যাতে উপকারভোগীরা কাজে লাগাতে পারে সে জন্য তাদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, কর্মসূচিগুলো এমনভাবে নিতে হবে যেন একজন নারী প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ঋণ পাবেন ও পণ্য বাজারজাত ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হবেন।

দুর্নীতির অভিযোগ

কর্মসূচিটির নাম ‘পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধকল্পে শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি’। ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকার এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে পিপলস এডুকেশন হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (পিইএইচডি) ফাউন্ডেশন। এই কর্মসূচি নিয়ে উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ।

গত ২৪ জানুয়ারি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৯তম বৈঠকে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে এই কর্মসূচি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ করেন দুজন সাংসদ। বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, বগুড়া-১ আসনের সাংসদ সাহাদারা মান্নান বলেন, দেখা গেছে, একই নাম, ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে। যে কয়টি নম্বরে ফোন করা হয়েছে, কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। যে দু-একটি থেকে সাড়া পাওয়া গেছে, তারা বলছে, সাঁতার প্রশিক্ষণ বিষয়ে তারা কিছুই জানে না।

সংসদীয় কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ বলেন, তালিকায় উপকারভোগীর সংখ্যা ১ হাজার জন বলা হলেও আছে ৭৮৩ জন। একই নাম ১০ বার দেওয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

পরে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ জানুয়ারি কর্মসূচির পরিচালক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পাপিয়া ঘোষকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গত ২৪ মার্চ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। প্রতিবেদনে অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে অব্যাহতি পাওয়া কর্মসূচি পরিচালক পাপিয়া ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অসুস্থ ছিলেন। এক স্বজনের মৃত্যুর ঘটনায় বিপর্যস্ত ছিলেন। এর মধ্যে কর্মসূচির প্রতিবেদন উপস্থাপনে মন্ত্রণালয়ের তাগিদের পর বাস্তবায়নকারী সংস্থা তাড়াহুড়ো করে তালিকা পাঠায়। এতে কিছু ভুল হয়ে থাকতে পারে।

সংসদীয় কমিটি সব কটি কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করছে বলে দাবি করেছেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক ধাপ পেরিয়ে একটি কর্মসূচি অনুমোদন পায়। জনবল কম। অনেক সময় একই ব্যক্তিকে একাধিক কর্মসূচি দেখভাল করতে হয়। সে ক্ষেত্রে কিছু উনিশ-বিশ হয়ে যায়।

অবশ্য দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, নারীদের জন্য কিছু একটা করতে হবে, এ রকম একটা মানসিকতা নিয়ে অনুকম্পানির্ভর কর্মসূচি করা হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কার জন্য কী প্রয়োজন, তা না ভেবেই অনেক সময় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে প্রশিক্ষণের জ্ঞান আর কাজে লাগে না।