প্রাণের বিনিময়ে টনক নড়ল কর্তৃপক্ষের

গর্তে পড়ে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে লরির চাপায় মারা যায় কলেজছাত্রী সাদিয়া আফরোজ। এরপর ভরাট করা হয় ডিটি সড়কের গর্ত। ২৬ নভেম্বরছবি: সৌরভ দাশ

‘অবহেলায় যাতে কোনো মায়ের বুক খালি না হয়’—চট্টগ্রাম নগরের ডিটি সড়কে গতিরোধক ও সংস্কারের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে এ রকম প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ৫ নভেম্বর এ মানববন্ধন হয়। এর মধ্যে ২২ দিন কেটে গেলেও তাঁদের সে দাবি মানার গরজ করেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এলাকাবাসীর আশঙ্কাই সত্যি হলো। কর্তৃপক্ষের অবহেলার খেসারত দিতে হলো কলেজছাত্রী সাদিয়া আফরোজকে। বেহাল সড়কের গর্তে পড়ে প্রাণ যায় তাঁর।

গত বৃহস্পতিবার সকালে স্বামীর মোটরসাইকেলে করে কোচিং থেকে বাসায় ফিরছিলেন সরকারি কমার্স কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া আফরোজ। পথে মনসুরাবাদ এলাকায় ডিটি সড়কের একটি গর্তে পড়ে যায় মোটরসাইকেল। ছিটকে পড়েন সাদিয়া। এ সময় পেছন থেকে আসা লরি চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দুই মাস আগে বিয়ে হওয়া সাদিয়ার। ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের পোর্ট কানেক্টিং (পিসি) রোডে গর্তে পড়ে প্রাইম মুভার ট্রেইলর উল্টে সিএনজি অটোরিকশাকে চাপা দেয়। এতে সিএনজি আরোহী তিনজন মারা যান।

বুধবার সকালে মো. আরমান শাকিলের মোটরসাইকেলের পেছন থেকে ছিটকে ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যান স্ত্রী সাদিয়া আফরোজ। এর পর থেকে ভেঙে পড়েছেন শাকিল। সুযোগ পেলে কবরে গিয়ে কান্না করছেন তিনি। গতকাল বিকেলেও কবরের পাশে গিয়ে অনেকক্ষণ কান্না করার পর স্বজনেরা তাঁকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। আকবরশাহ কলোনি এলাকা, চট্টগ্রাম, ২৬ নভেম্বর
ছবি: সৌরভ দাশ

মনসুরাবাদের এলাকাবাসীর মানববন্ধনের পরে টনক না নড়লেও এখন নড়েচড়ে বসেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কলেজছাত্রীর মৃত্যুর পরেই সড়কের গর্ত ভরাট করে সংস্থাটি। গত শুক্রবার দুপুরের পর থেকে গর্ত ভরাট করতে থাকেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। আর সড়কের এ অংশে বারবার বেহাল হওয়ার জন্য ওয়াসার পানির সংযোগ পাইপে লিকেজ (ছিদ্র) এবং রাস্তা সংস্কারকাজে নিয়োজিত ঠিকাদারের অবহেলাকে দায়ী করছেন সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীরা।

সিটি করপোরেশনের এমন ভূমিকায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা। শুক্রবার রাস্তা সংস্কারের সময় সিটি করপোরেশনের কর্মীদের কাছে ক্ষোভও প্রকাশ করেন তাঁরা। তাঁদেরই একজন চাকরিজীবী মোহাম্মদ মুরাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন-চার মাস ধরে সড়কটি বেহাল। অনেকগুলো গর্ত। বারবার বলার পরেও টনক নড়েনি সিটি করপোরেশনের। এখন মানুষ মারা যাওয়ার পর তাদের খবর হয়েছে। গর্তগুলো আগে ঠিক করলে সমস্যা কী ছিল? আর গর্ত ঠিক করতে তো বেশি টাকা লাগে না। গর্তগুলো ভরাট করে দিলে আজ মেয়েটিকে মরতে হতো না।’

‘অবহেলায় যাতে কোনো মায়ের বুক খালি না হয়’—চট্টগ্রাম নগরের ডিটি সড়কে গতিরোধক ও সংস্কারের দাবিতে ৫ নভেম্বর মানববন্ধন করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা
ফাইল ছবি

মনসুরাবাদ এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ কামাল, স্থানীয় সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ সুমন ও ট্রাকচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ভাষ্য, সড়কের এই অংশ (মনসুরাবাদ) প্রায় সময় খারাপ থাকে। সিটি করপোরেশন মাঝেমধ্যে ঠিক করে। কিন্তু কাজের মান ভালো না হওয়ায় তা বেশি দিন টেকে না। আর এই সড়কে প্রচুর ভারী গাড়ি চলাচল করে। ফলে গাড়ির চাপে অল্প কিছুদিনের মধ্যে সড়কে গর্ত হয়ে যায়।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নগরের গুরুত্বপূর্ণ ডিটি সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ছয় কিলোমিটার। সড়কের বিভিন্ন অংশে সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু মনসুরাবাদসহ কিছু এলাকায় পিচঢালার কাজ বাকি রয়েছে। আরআর-এবি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৬ কোটি ৪১ লাখ টাকার এ সংস্কারকাজের কার্যাদেশ পেয়েছে।

এখন মানুষ মারা যাওয়ার পর তাদের খবর হয়েছে। গর্তগুলো আগে ঠিক করলে সমস্যা কী ছিল? আর গর্ত ঠিক করতে তো বেশি টাকা লাগে না। গর্তগুলো ভরাট করে দিলে আজ মেয়েটিকে মরতে হতো না।
মোহাম্মদ মুরাদ, স্থানীয় বাসিন্দা

সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী বিপ্লব দাশ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সড়কটি কিছুদিন আগেও সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু রাস্তার নিচ দিয়ে ওয়াসার সংযোগ পাইপ গেছে। সে পাইপে অনেকগুলো লিকেজ (ছিদ্র) রয়েছে। ফলে পানি বের হয়ে সংস্কারের পরেও রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। ওয়াসাকে বারবার বলা হলেও তারা তা সংস্কার করেনি। তাঁর দাবি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আরআর-এবি এন্টারপ্রাইজকে রাস্তা সংস্কারের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। রাস্তায় কাজ দ্রুত শেষ করতে গত আগস্ট ও অক্টোবরে দুই দফা চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা মাঝেমধ্যে কিছু কাজ করলেও অবহেলা ছিল।

সিটি করপোরেশনের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, ডিটি রোডের মনসুরাবাদ অংশে পাইপলাইনে কোনো লিকেজ নেই। আর সিটি করপোরেশনও এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। আর ঠিকাদার মো. শাহজাহান ফোন ধরেননি।

নগরের ডিটি সড়কের গর্তে মোটরসাইকেল থেকে পড়ে একজন ছাত্রীর মৃত্যু হওয়ার পর ওই সড়কের বিভিন্ন গর্তে সতর্কতা হিসেবে লাল কাপড় বেঁধে খুঁটি পুতে দেওয়া হয়।
ফাইল ছবি

সার্বিক বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নালায় পড়ে, সড়কের গর্তে পড়ে অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর দায় সংস্থাগুলোকে নিতে হবে। কিন্তু এখানকার সংস্থাগুলো মৃত্যুর দায় একে অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। তবে জনগণের নির্বাচিত সংস্থা হিসেবে সিটি করপোরেশনকেই এসব ঝুঁকিপূর্ণ নালা, সড়কের গর্ত চিহ্নিত করে ঝুঁকি দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে।

আরও পড়ুন