ফিরে এসেছে শালবন

নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায় দখল হওয়া জমিতে আবার গড়ে তোলা হয়েছে শালবন। এ উদ্যোগে মূল ভূমিকা পালনকারী বন কর্মকর্তা লক্ষ্মণ ভৌমিক বনের পাশে দাঁড়ানো l প্রথম আলো
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায় দখল হওয়া জমিতে আবার গড়ে তোলা হয়েছে শালবন। এ উদ্যোগে মূল ভূমিকা পালনকারী বন কর্মকর্তা লক্ষ্মণ ভৌমিক বনের পাশে দাঁড়ানো l প্রথম আলো

কিছুদিন আগেও যেখানে ছিল একরের পর একর বিস্তৃত চাষের জমি, এখন সেখানে ঘন শালবন। একটু বাতাস বইলেই ধ্বনিত হয় পাতার মর্মর। রাতে প্রহরে প্রহরে ডেকে ওঠে শিয়াল।
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায় ধীরে ধীরে ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া বনভূমি। যাঁরা বনের জমি দখল করে চাষাবাদ করছিলেন, তাঁরা জমি আবার বন বিভাগকে ফিরিয়ে দিয়ে সেই জমিতে লাগানো বনভূমির যত্ন নিচ্ছেন। তাঁরাই এখন বনের রক্ষক। এর বিনিময়ে তাঁরা হয়েছেন বনের উপকারভোগী।
সারা দেশে যেখানে ধীরে ধীরে বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার চিত্র, সেখানে ধামইরহাটের এই বিপরীত যাত্রা অনেককে বিস্মিত করে। এই জাদুকরি পরিবর্তনের পেছনের নায়কটি একজন সাধারণ বন বিট কর্মকর্তা। তাঁর নাম লক্ষ্মণ ভৌমিক। এই উপজেলায় বিভিন্ন জাতের গাছের ছোট-বড় প্রায় ২০০টি বাগান রয়েছে। একমাত্র ‘শালবন’ ছাড়া সব কটিই লক্ষ্মণ ভৌমিকের গড়ে তোলা। উপজেলার ১৪ হাজার ভূমি দখলকারীকে তিনি বদলে দিয়ে উপকারভোগীতে পরিণত করেছেন। বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করেছেন ৪৫২ একর। এ ছাড়া তিনি ৫৬২ কিলোমিটার রাস্তায় বনায়ন করেছেন।
সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) ইউনুস আলী বলেন, রাজশাহীর ধামইরহাট এলাকাটাকেই বদলে দিয়েছেন লক্ষ্মণ ভৌমিক। সীমান্তবর্তী এলাকায় সমৃদ্ধ একটা বনভূমি গড়ে উঠেছে তাঁর বদৌলতে। তাঁর মতো লোক বন বিভাগে কম আছে।
রাতের প্রহরে শিয়ালের ডাক
সম্প্রতি ধামইরহাট বন বিট কর্মকর্তার কার্যালয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। তবু রাতেই কার্যালয়ে পাওয়া গেল তাঁকে। ঘড়ির কাঁটা তখন আটটা ছুঁই-ছুঁই। চারদিক থেকে একযোগে শত শত শিয়াল ডেকে উঠল। অনেক দিন একসঙ্গে এত শিয়ালের ডাক শোনার অভিজ্ঞতা নেই। লক্ষ্মণ ভৌমিক বললেন, বনভূমি বাড়ার কারণে এই এলাকা এখন বন্য প্রাণীর আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
সারা দেশে দুটি অঞ্চলে শালবনের দেখা মেলে। একটি গাজীপুর-টাঙ্গাইল অঞ্চল, আরেকটি দেশের উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ-দিনাজপুর অঞ্চল। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলেই বিস্তৃত শালবনগুলো বেশি উজাড় হয়ে গেছে। সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছোট ছোট শালবন। এর মধ্যে একমাত্র ধামইরহাটেই শালবন আবার ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সফল হয়েছে।
অভিনব কায়দায় জমি উদ্ধার
লক্ষ্মণ ভৌমিকের কাছ থেকে জানা গেল বন বিভাগের জমি উদ্ধারের গল্প। শুরুতে দখলদারেরা তির-ধনুক, লাঠি-ফলা নিয়ে অবরোধ করেছেন। গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েছেন। যাঁরা ওভাবে বাধা দিয়েছেন, তাঁরাই এখন তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। শক্তি প্রয়োগ না করে তিনি তাঁদের বুঝিয়েছেন, অবৈধ দখলদার হয়ে থাকার চেয়ে বন বিভাগের উপকারভোগী হলে তাঁদের অনেক লাভ। আর্থিক সুবিধাও পাবেন, আবার আইনি ঝামেলাতেও পড়তে হবে না।
উপজেলার উত্তর চকরহমত গ্রামের আমেদ আলী মণ্ডলের দখলে ছিল বন বিভাগের নয় একর জমি। এ ছাড়া তাঁর নিজের কোনো জমি ছিল না। তিনি এই জমির দখল ছাড়তে নারাজ ছিলেন। সরকারি লোকজনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তিনিই এখন সেই জমি ছেড়ে দিয়ে উপকারভোগী হয়েছেন। তিনি এখন বন বিট কর্মকর্তার বড় ভক্ত।
বনের জায়গা দখলকারীদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সড়কের দুই পাশ এবং সরকারি খাসজমিতে সামাজিক বনায়ন করে সেসব গাছ বিক্রির ৪৫ শতাংশ অর্থ তাঁদের দেওয়া হয়।
পরদিন আমেদ আলীর সঙ্গে দেখা। বয়স প্রায় ৫৫। বললেন, লক্ষ্মণ ভৌমিক তাঁর কাছ থেকে বনের জমি ফিরিয়ে নিয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁকে পথে বসাননি। আমেদ আলী প্রথমে জমির চারদিক দিয়ে গাছ লাগালেন। মাঝখানে আবাদ করার সুযোগ পেলেন। আস্তে আস্তে গাছ বাড়াতে থাকলেন। যখন পুরো জমি গাছে ভরে গেল, তখন তিনি উপকারভোগী হিসেবে বন বিভাগের কাছ থেকে (২০০৪-০৫ অর্থবছরে) ৪ লাখ টাকা লভ্যাংশ পেলেন।
একইভাবে চকচান্দিরা গ্রামের গৃহপরিচারিকা হামিদা বেগম ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পেয়েছেন ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৫০০ টাকা। একই গ্রামের দরিদ্র ইসহাক আলী পেয়েছেন ৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে তিনি পেয়েছিলেন ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই গ্রামের ফজলুর রহমান পেয়েছেন ১২ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ টাকা। এই টাকার চেক প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে তাঁকে প্রদান করেছেন।
কঞ্চি থেকে বাঁশবন
কঞ্চি থেকে বাঁশের চারা তৈরি করে উপজেলার সিলিমপুর এলাকায় এক প্লটে ২৬ একর জমিতে বাঁশবন তৈরি করেছেন লক্ষ্মণ ভৌমিক। ২০১৪ সালে শুরু করেছিলেন। দুই বছরে এখন সেটা ঘন বাঁশবন।
বাঁশবাগান থেকে বের হয়ে আত্রাই নদের ধার দিয়ে যেতে পশ্চিম তীরে চোখে পড়ল বিশাল বনভূমি। লক্ষ্মণ ভৌমিকের হিসাবমতে, সেটা ২০০ একরের বন। নদীর তীরে জেগে ওঠা খাসজমিতে শাল, জারুল, বহেড়া, আমলকী, ডুমুর, অর্জুন, জাম, ইপিল ইপিল গাছ রোপণ করেছেন। দুই বছর আগের দেখা সেই বাগান রীতিমতো অচেনা বনভূমিতে পরিণত হয়েছে।
মাঠকর্মী থেকে বনকর্মী
লক্ষ্মণ ভৌমিকের বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলার কলম গ্রামে। ১৯৮৩ সালে বন বিভাগের মাঠকর্মী হিসেবে রাজশাহীতে কাজে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি বন বিট কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০৪ সাল থেকে ধামইরহাট উপজেলায় কর্মরত আছেন। শুরুতেও ধামইরহাটে ছিলেন। মাঝখানে কয়েক বছরের জন্য নিয়ামতপুরে ছিলেন। বন বিট কর্মকর্তা হিসেবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে ‘বন বিভাগ কর্তৃক সৃজিত বাগান ক্যাটাগরিতে’ ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত (২০১২ সাল ছাড়া) ‘বৃক্ষরোপণে সারা দেশে প্রথম’ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১২ সালে তিনি আবেদন করেননি।
ধামইরহাট প্রেসক্লাব থেকে লক্ষ্মণ ভৌমিককে তিনবার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। প্রেসক্লাবের সভাপতি আবদুল মালেক সরদার বলেন, দখলদারেরা তাঁকে হুমকি দিয়েছে। বাড়িতে ডাকাত হামলা করেছে। তবু তিনি দমে যাননি। সবার ধারণা, এই বিট কর্মকর্তা এখান থেকে চলে গেলে তিন মাসের মধ্যে এই বন উজাড় হয়ে যাবে।