ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গল্প অবলম্বনে তৈরি সিনেমা ভ্রান্তিবিলাস কখনো দেখেননি তাঁরা। কিন্তু রিক্তা-মুক্তাদের নিয়ে ‘ভ্রান্তির বিলাসিতা’ হরহামেশাই ঘটছে। জাতীয় মহিলা দলের ফুটবলার জান্নাতুল ফেরদৌস রিক্তা ও ফাতেমা তুজ জোহরা মুক্তা। কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন তো শুরুর দিকে বুঝতেই পারতেন না কে রিক্তা আর কে মুক্তা! বুঝবেন কী করে? যমজ কন্যাদের নিয়ে যে গোলকধাঁধায় পড়তেন বাবা আকবর আলীও!
দুই বোনের মধ্যে রিক্তা বড়। মুক্তার চেয়ে মাত্র মিনিট তিনেক আগে পৃথিবীর আলো দেখেছেন। এঁদের মতোই ফুটবলে রয়েছে আরেক যমজ-কন্যা। সম্প্রতি এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ মেয়েদের ফুটবলে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে তাজিকিস্তান গিয়েছিলেন যমজ বোন—আনাই মগিনি ও আনুচিং মগিনি। কাকতালীয়ভাবে খাগড়াছড়ির দুই কিশোরীর বয়সের ব্যবধানও তিন মিনিট! আনাই বড়, আনুচিং ছোট।
রিক্তা-মুক্তাদের বাবা আকবর আলী সাতক্ষীরার ফুটবল কোচ। বাবা শখ করে দুই মেয়ের নাম রেখেছিলেন রিক্তা-মুক্তা। যেন মুক্তার মতোই ঝিলিক দিচ্ছে দুই বোনের প্রতিভা। হ্যান্ডবল দিয়ে তাঁদের ক্যারিয়ার শুরু। তবে হ্যান্ডবল নয়, ফুটবলটা এখন খেলছেন নিয়মিত। পাশাপাশি জাতীয় খো খো দলেও খেলছেন দুই বোন। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতে এসএ গেমসে খো খোতে বাংলাদেশ মহিলা দলের রুপা জেতায় দুই বোনের ছিল যথেষ্ট অবদান। এরপর এপ্রিলে ভারতে হওয়া এশিয়ান খো খো চ্যাম্পিয়নশিপেও রুপাজয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন মুক্তা। গত মার্চে সর্বশেষ জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ময়মনসিংহকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বিজেএমসি। ওই দলেও খেলেছেন দুই বোন। ২০০৮ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে মালয়েশিয়ায় খেলেছেন রিক্তা-মুক্তা। তবে পাকিস্তানে হওয়া সর্বশেষ সাফ দলে ডাক পেয়েও পরীক্ষার জন্য খেলতে যেতে পারেননি মুক্তা। বিশ্ববিদ্যালয়েও মেধাবী মুখ রিক্তা-মুক্তা। পড়াশোনা করছেন যশোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়াবিজ্ঞান ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে। তৃতীয় বর্ষে জিপিএ চারের মধ্যে ৩.৯৬ পয়েন্ট মুক্তার, রিক্তার ৩.৯২।
আকবর আলী গর্বভরে বলছিলেন, ‘আমি সব সময় নতুন কিছু তৈরির চেষ্টা করি। এ জন্যই নিজের মেয়েদের খেলাধুলায় দিয়েছি।’ অথচ শুরুর দিকে মেয়েদের ফুটবল খেলতে পাঠানোর জন্য মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছিলেন আকবর আলী। ওই সময় যমজ কন্যারা রাস্তায় বের হলেই ইভ টিজিংয়ের শিকার হতেন। তবে দিন বদলেছে। এখন এই মেয়েরাই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে এলাকার সবাই বলে, ‘ওই দ্যাখ, রিক্তা-মুক্তারা যায়।’
রিক্তা শান্ত, মুক্তা চঞ্চল। রিক্তা আইসক্রিম পছন্দ করেন তো মুক্তা মিষ্টি। রিক্তার পছন্দ মেসি, মুক্তার রোনালদো। দুজনকে নিয়ে সতীর্থরাও মাঠে মাঝেমধ্যে ধন্দে পড়েন। আত্মীয়স্বজনেরাও কখনো কখনো বুঝতে পারেন না। এমনই এক মজার ঘটনা বলছিলেন মুক্তা, ‘বড় চাচা আমাদের দুই বোনকে ভীষণ আদর করেন। ঈদের সময় সালামি দেন চাচা। একবার রিক্তা প্রথমে গিয়ে ওর সালামি নিয়ে আসে। একটু পর গিয়ে আবার আমারটাও নিয়ে আসে। আমি যখন চাচার কাছে গেলাম, চাচা বললেন, এই মাত্র না টাকা নিয়ে গেলি!’ ইদানীং হিজাব পরেন রিক্তা। তাই দুজনকে আলাদা করতে সমস্যা হয় না।
আনাই ও আনুচিংয়ের অবশ্য এমন সমস্যা হয় না। দুজনের চেহারায় একটু ভিন্নতা রয়েছে। এর ওপর আনুচিংয়ের চুল ছেলেদের মতো বব কাট। মাঠে অবশ্য দুজনই দুর্দান্ত খেলে। তাজিকিস্তানে গিয়ে গ্রুপ পর্বে নেপালকে ৯-০ গোলে হারানোর ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছে ফরোয়ার্ড আনুচিং। ফাইনালে ভারতকে হারানোর ম্যাচে ডিফেন্ডার আনাইও করেছিল একটি গোল! সাত ভাই-বোনের সংসারে সবার ছোট এই যমজ। বাবা রি ফ্রু মগের স্বপ্ন দুই মেয়েই একদিন জাতীয় দলে খেলবে। সেই স্বপ্নযাত্রার শুরুটা মোটেও মন্দ হয়নি আনাইদের। তাজিকিস্তানের হোটেলের বয়-কর্মচারীরা নাকি এই দুজনের খেলা দেখতেই মাঠে যেত। ঢাকায় ফিরে আনাই বলছিল, ‘আমরা দুই বোন যেখানেই যেতাম ওরা আমাদের সঙ্গে যেত। মাঠে শুধু আমরা দুই বোন কী করি সেটাই দেখত।’
শুধু চেহারাতেই মিল নয় রিক্তা-মুক্তা আর আনাই-আনুচিংদের। মাঠেও এরা একটা লক্ষ্য নিয়েই বল পায়ে ছোটে। এই যমজদের স্বপ্নও অভিন্ন—লাল-সবুজ পতাকাটা আরও ওপরে তুলে ধরা।