ফেসবুকজুড়ে ‘নারী ব্ল্যাকআউট’ কেন?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ফিড ছেয়ে গেছে কালো রঙের প্রোফাইল ছবিতে। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ হিসেবে অনেকেই এই ব্ল্যাকআউট উদ্যোগে অংশ নিয়েছেন। আবার এর বিপক্ষেও রয়েছেন অনেকেই
ছবি: সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ফিড ছেয়ে গেছে কালো রঙের প্রোফাইল ছবিতে। গতকাল সোমবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার খবর প্রকাশের পর নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ হিসেবে অনেকেই এই ব্ল্যাকআউট উদ্যোগে অংশ নিয়েছেন। আবার এর বিপক্ষেও রয়েছেন অনেকেই। এ নিয়েও ফেসবুকজুড়ে চলছে বিতর্ক। তবে নারী ব্ল্যাকআউট ফেসবুকের আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ নয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

নারীদের আজ মঙ্গলবার নির্দিষ্ট সময়জুড়ে ফেসবুকের প্রোফাইলে নিজের নির্বাচিত ছবির জায়গায় কালো রঙের ছবি রাখার আহ্বান জানিয়ে গতকাল সোমবার থেকে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ইনবক্সে পাঠানো হয় ইংরেজি একটি বার্তা। বার্তাটি ছিল এমন ‘কাল, নারী ব্ল্যাকআউট চলবে সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। নারী ছাড়া বিশ্বকে কেমন দেখায় বোঝাতেই এই আন্দোলন। আপনার প্রোফাইল ছবি কালো বর্গাকৃতির করে দিন, যাতে পুরুষ চমকে ওঠে এই ভেবে যে নারীরা গেল কোথায়। এই বার্তা শুধু নারীদের পাঠান...এটা পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ। এটা মজা করার বিষয় নয়। ছড়িয়ে দিন।’

খোঁজ করে এই উদ্যোগের পেছনে কারা রয়েছে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। তবে ফেসবুকে ‘ফিমেল ব্ল্যাকআউট অ্যাগেইনস্ট অ্যাবিউজ টুওয়ার্ডস উইমেন’ নামের অলাভজনক সংস্থা উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি পেজ পাওয়া গেছে। ওই পেজে নারীর অধিকার, বঞ্চনা ও সাফল্যের বিভিন্ন বিষয় পোস্ট করা হয়।

নারী ব্ল্যাকআউটের এই উদ্যোগের সঙ্গে ব্ল্যাকআউট ডে ২০২০ (#BlackOutDay2020) এবং ব্ল্যাকআউটটিউজডে ( #blackouttuesday) আন্দোলনের মিল রয়েছে।

মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে ‘ব্ল্যাকআউট ডে ২০২০’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এবং অধিকারকর্মী ক্যালভিন মারটির দুই মাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে এই উদ্যোগ জনপ্রিয় করে তোলেন। বর্ণবাদী নীতি ও চর্চা বন্ধে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ সৃষ্টিতে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা এক জোট হয়ে পরিকল্পনা করছিলেন যে তাঁরা কৃষ্ণাঙ্গ মালিকানাধীন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনাকাটা করবেন ও বিনিয়োগ করবেন। অন্য কোথাও অর্থ খরচ করবেন না। তাঁদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটার ছেয়ে যায় কালো প্রোফাইল ছবিতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আন্দোলনকে সমর্থন দেয় প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল (পিজি) এবং সিসকো সিস্টেমের মতো বড় প্রতিষ্ঠান।

যুক্তরাষ্ট্রে এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়ে গুলিতে আহমাউদ আরবেরির মৃত্যু এবং ১৩ মার্চ পুলিশের গুলিতে ব্রিওনা টেইলর নিহত হওয়ার ঘটনায় এ বছরের মে মাসের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ আন্দোলন শুরু হয়। মে মাসের শেষের দিকে পুলিশের হাঁটু চাপায় জর্জ ফ্লয়েড দম বন্ধ হয়ে মারা যান। এই তিন কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যুর প্রতিবাদে ২ জুন মঙ্গলবার ব্ল্যাকআউট টিউজডের আয়োজন করা হয়েছিল।

মার্কিন অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ইনসাইডার জানিয়েছে, গানের জগতের দুই কৃষ্ণাঙ্গ নারী জামিলা থমাস ও ব্রিয়ানা আগেমাংয়ের যৌথ উদ্যোগ হ্যাশট্যাগ দি শো মাস্ট বি পজড (#TheShowMustBePaused) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্ল্যাকআউট টিউজডে পদক্ষেপে কালো বর্গাকৃতির ছবি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নীরবতা পালন করা হয় এবং ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করা হয়। এতে সংহতি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বর্গাকৃতির কালো ছবি ব্যবহার করেছেন ওই সময়ে।

এদিকে নারী ব্ল্যাকআউট নতুন বিষয় নয় বলে জানা গেছে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসে দুই বছর আগে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে। হুবহু একই বার্তার কথা উল্লেখ করে ফোর্বসে ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এক নিবন্ধে বলা হয়, এই আন্দোলনের পেছনে কোনো অফিশিয়াল গ্রুপ বা সংস্থার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এটা ২০১৭ সালের শুরুতে শুরু হয় এবং বলা হয় এটা পারিবারিক বা যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। নিবন্ধের লেখক অ্যালিসন কাপিন উদ্যোগটির সমালোচনা করে বলেছিলেন, যখন নারীদের আরও বেশি সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন, তখন নারীদের মুছে দেওয়া হচ্ছে এবং চুপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

দেশে এই নারী ব্ল্যাকআউট নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন ফেসবুক ব্যবহারকারী অনেক নারী। জাকিয়া আহমেদ নামের একজন লিখেছেন, ‘অনেকেই ইনবক্সে ব্ল্যাকআউটের বার্তা পাঠিয়েছেন, তাঁদের ধন্যবাদ। কিন্তু আমি এই ব্ল্যাক আউটে যাব না। আমি দুঃখিত। নিজেকে লুকিয়ে আমি প্রতিবাদে অংশ নিতে চাই না। তবে প্রতিবাদের ভাষা সবার এক নয়, যাঁরা করছেন, তাঁদের ধন্যবাদ। কিন্তু আমি করব না, কারণ এ লজ্জা নারীর নয়। তাই আমি নিজেকে লুকাব না।’

যাঁরা পক্ষে রয়েছেন, তাঁরা এটাকে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রোকসানা ইয়াসমিন তিথি নামের একজন লিখেছেন, ‘আমি প্রোফাইল পিক কালো করেছি নিজেকে লুকানোর জন্য নয়। কালো শোক বা প্রতিবাদ প্রকাশ করার রং।...কেউ কেউ বিষয়টিকে নিয়ে জল ঘোলা করছেন। আপনার ভালো লাগেনি আপনি প্রো-পিক কালো করেননি। কিন্তু অন্যদের নিরুৎসাহিত করার অধিকার আপনার নেই। কিছু কিছু নারী আছেন, যাঁরা সব সময়ই নারী অধিকারের ঝান্ডা নিয়ে ঘোরেন, কিন্তু যখন সময় আসে, তখন তাঁরা বিভিন্ন অজুহাতে নিজেদের গুটিয়ে রাখেন।’

কবি ও সাংবাদিক শান্তা মারিয়া লিখেছেন, ‘প্রোফাইল পিকচার কালো করা মানে অন্ধকারে মুখ লুকানো নয় হে ভ্রান্ত। ধরলাম এ দিয়ে কিছু হবে না, কিন্তু সবার একত্রে ঘৃণার প্রকাশ তো ঘটানো গেল। মানুষ তাহলে কেন মৌন মিছিল করে বা কালো ব্যাজ ধারণ করে বা ১/২ ঘণ্টার জন্য কর্মবিরতি পালন করে? এটা হলো প্রতীকী প্রতিবাদ। বিচ্ছিন্নতা কোনো দিনই সুফল বয়ে আনে না, অন্তত আন্দোলনের ক্ষেত্রে।’

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবাদের ভাষা একেকজনের একেক রকম। কারও এতে সমর্থন থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে। নারী ব্ল্যাকআউটের পক্ষে বা বিপক্ষে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের লক্ষ্য একটাই—নারী নির্যাতন বন্ধ হোক। তাই এমন শক্তিশালী আহ্বান প্রয়োজন, যেখানে কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে না। ধর্ষণের ঘটনায় ঘরে ঘরে মেয়েদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এখন সবাইকে ধর্ষণসহ সব ধরনের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংহতি প্রকাশ করে জোরে আওয়াজ তুলতে হবে, সোচ্চার হতে হবে।