বগুড়ার শিয়া মসজিদে হামলা চালায় জেএমবি ও শিবির

বগুড়ায় শিয়া মসজিদে বন্দুক হামলা ও মুয়াজ্জিন হত্যার ঘটনায় অংশ নেয় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং ইসলামি ছাত্রশিবির। মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের হত্যায় দেশীয় জঙ্গিদের পরিকল্পিত হামলা ছিল সেটি।


ঘটনার প্রায় ১৪ মাস পর আদালতে দাখিল করা মামলার অভিযোগপত্রে তা বলা হয়েছে। হামলার এক দিন পর এর দায় স্বীকার করেছিল আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। তবে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি ছিল দেশীয় জঙ্গিদের পরিকল্পিত হামলা। আটক ও পলাতক নয় জঙ্গির বিরুদ্ধে এই অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধে নিহত চারজন ছাড়াও সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে দিনাজপুরে ইসকন মন্দিরে হামলার দুই আসামিসহ পাঁচজনকে।

২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার চককানুপুর গ্রামে মসজিদ-ই-আল মোস্তফা শিয়া মসজিদে জঙ্গি হামলা হয়। হামলায় শিয়া মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হন। এর মধ্যে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন (৫৮)।

তদন্তকারী কর্মকর্তা (শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) কামরুজ্জামান মিয়া কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে বগুড়ার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত-২-এ শিয়া মসজিদে হামলা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গত রোববার আমলি আদালতের বিচারক মো. কামরুজ্জামান অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। আগামী ৮ মার্চ মামলার পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে বন্দুক হামলায় অংশ নিয়েছিল জেএমবি ও ইসলামি ছাত্রশিবিরের প্রশিক্ষিত ১৩ সদস্য। এর মধ্যে চারজন কারাগারে, পাঁচজন পলাতক ও চারজন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। মহাস্থানগড়ে বসে মসজিদে হামলা ও ইমাম-মুয়াজ্জিন হত্যার পরিকল্পনা বৈঠক হয়েছিল। পরে স্কুলব্যাগে অস্ত্র ও গ্রেনেড ভরে দুটি মোটরসাইকেলে চেপে ছয় জঙ্গি শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামে শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদ-ই-আল মোস্তফায় হামলায় অংশ নেন। নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলার পর মোটরসাইকেলে চেপেই পালিয়ে যান জঙ্গিরা। শিয়া সম্প্রদায়কে কাফের ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জেএমবি।

যে নয়জন জঙ্গির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে, তাঁরা হলেন জয়পুরহাট সদরের সোঠাহার গ্রামের ইয়াছিন আলী (৪০), বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার আটমুল গ্রামের ফকিরপাড়ার এমদাদুল হক (২৮), একই গ্রামের কুলুপাড়ার আবদুল বাছেদ (২৭), একই গ্রামের পূর্বপাড়ার আবদুল হামিদ ওরফে হামিদুল (২২), শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়া গ্রামের আবদুল মমিন মণ্ডল (২৫), ক্ষুদ্র কুষ্টিয়া গ্রামের রাজিবুল ইসলাম ওরফে বাদল (২৬), গাবতলী উপজেলার গোরদহ সরকারপাড়ার খাদেমুল ইসলাম ওরফে বাদশা (২৪) ও আজাদ প্রামাণিক (২৪) এবং গাইবান্ধা সদরের তিনদহ পশ্চিমপাড়ার আজাদুল কবিরাজ ওরফে বিপ্লব (৩২)।

এর মধ্যে ইয়াসিন, এমদাদুল, বাসেদ ও মমিনকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে এবং বাদল, হামিদুল, খাদেমুল, আজাদ ও বিপ্লব পলাতক রয়েছেন। ইয়াসিন হামলার আদ্যোপান্ত জানিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় যে পাঁচজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন জেএমবির পুরোনো সদস্য ও শিবগঞ্জের সৈয়দ দামগাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন ওরফে আর্মি আনোয়ার, মোলামগাড়ি গ্রামের কওমি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ শামসুল আলম, হরিপুর গ্রামের মাদ্রাসাছাত্র জুয়েল রানা, দিনাজপুরে ইসকন মন্দিরে হামলা মামলার আসামি দুই জেএমবি সদস্য শরিফুল ইসলাম ওরফে ডেনিস ও মোবাশ্বের আলম খন্দকার ওরফে প্রিন্স।

হামলায় ব্যবহৃত অত্যাধুনিক একে ২২ বোরের রাইফেলসহ অন্যান্য অস্ত্র আলামত হিসাবে উদ্ধারের কথা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

তদন্তকারী কর্মকর্তা কামরুজ্জামান মিয়া বলেন, শিয়া মসজিদে হামলা ও পরিকল্পনায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও ইসলামি ছাত্রশিবিরের ১৩ সক্রিয় সদস্য সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া ছয়জনের মধ্যে চারজনই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন।

তাঁদের মধ্যে জয়পুরহাটের কমরগ্রামের মিজানুর রহমান ওরফে কাওছার গত বছরের ৮ জুন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বুড়িগঞ্জ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

গত বছরের ৭ জুন রাজধানীর পল্লবী এলাকার কালসী সেতুর কাছে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান পরিচালনার সময় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার মিঠাপুকুর গ্রামের সুলতান মাহমুদ ওরফে কামাল ওরফে রানা এবং জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার কানুপুর গ্রামের তারেক হোসেন ওরফে মিলু ওরফে ওসমান।

গত বছরের ৭ আগস্ট রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ঝিকড়ার জোয়ানভাগ এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নওগাঁর মান্দা উপজেলার পারইল গ্রামের আনোয়ার হোসেন।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, শিয়া মসজিদে হামলার মামলায় ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর জয়পুরহাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জেএমবি সদস্য ইয়াছিন আলীকে। তিনি হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী। একই দিন শিবগঞ্জ থেকে জেএমবির দুই সদস্য আবদুল বাছেদ ও এমদাদুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। ১২ ডিসেম্বর ইয়াসিন আলী বগুড়ার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ফেরদৌস ওয়াহিদের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে ইয়াসিন হামলার আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ব্যঙ্গ করে। এ কারণেই তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ এবং মসজিদে হামলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।’

ইয়াছিনের দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে গত বছরের ২৬ এপ্রিল বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়া-মধ্যপাড়া গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্র আবদুল মমিনকে (২৫)। তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় হামলায় ব্যবহৃত আমেরিকায় তৈরি অত্যাধুনিক একে ২২ বোরের একটি রাইফেল, একটি বিদেশি পিস্তলসহ ৫২টি তাজা গুলি।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, হামলার আগে জঙ্গিরা হরিপুর মসজিদ-ই-আল মোস্তফায় গিয়ে রেকি করেন। মাগরিবের নামাজে আসা মুসল্লিদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর দুটি মোটরসাইকেলে চেপে কাওছার, রানা, বিপ্লব, বাদশা, বাদল ও আনোয়ার মহাস্থানগড়ে একত্র হন। সেখান থেকে স্কুলব্যাগে ভরে অস্ত্র ও গ্রেনেড নিয়ে জঙ্গিরা শিয়া মসজিদের হামলার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মসজিদের পাশে একটি ইটভাটায় মোটরসাইকেল রেখে বাদল ও বিপ্লব অপেক্ষা করতে থাকেন। আর কাওছার, আনোয়ার, রানা ও বাদশা মসজিদে হামলায় অংশ নেয়। তাঁরা মসজিদের বাইরের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। এরপর রানা মসজিদের মূল দরজা বন্ধ করে দেন। জঙ্গি আনোয়ার একে ২২ অস্ত্র দিয়ে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। অস্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুলিভর্তি থাকায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গুলি পিলারের সঙ্গে লাগে। এরপর হাতে থাকা অস্ত্রের ট্রিগারে চাপ দেন কাওছার। কাওছারের গুলিতে মুয়াজ্জিনসহ মুসল্লিরা গুলিবিদ্ধ হয়। দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই হামলা শেষ করে মোটরসাইকেলে চেপে দ্রুত পালিয়ে যান জঙ্গিরা।

এ ঘটনায় মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ সোনা মিয়া বাদী হয়ে ওই রাতেই শিবগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি মামলা করেন।