বছ‌রের পর বছর ঝু‌লে থা‌কে শ্রমি‌কের মামলা

চাকরিতে পুনর্বহাল, পাওনা আদায়, মালিক-শ্রমিক চুক্তির লঙ্ঘন, বেতন-ভাতার দাবি, ক্ষতিপূরণ আদায় এবং ট্রেড ইউনিয়ন-সংক্রান্ত মামলা শ্রম আদালতে করা হয়। জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার একজন বিচারক শ্রম আদালতের বিচারক (শ্রম আদালতের কার্যক্রমে বিচারককে বলা হয় চেয়ারম্যান) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে বিচারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

ছবি: সংগৃহীত

মৌলভীবাজারের রাজনগর টি এস্টেট লিমিটেডের শ্রমিক দীপ চান। চাকরিচ্যুতির পর পুনর্বহাল চেয়ে শ্রম আদালতে মামলা করেন ২০১২ সালে। সেই মামলা এখনো ঝুলে আছে। সিলেট-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়ায় ক্লান্ত তিনি। দীপ চান বলেন, ‘এখন আর চট্টগ্রাম আসি না। বিচারের আশাও করি না।’

কক্সবাজার বাস শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মচারী মো. আলীও আট বছর আগে পাওনা আদায়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। সেই মামলারও সুরাহা হয়নি এখনো।

দীপ চান ও আলীর মতো হাজারো শ্রমিকের মামলার বিচার ঝুলে আছে বছরের পর বছর। অথচ সর্বোচ্চ ১৫০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে।

মো. আলী গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১২ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম প্রথম শ্রম আদালতে মামলা করেন। মামলার খোঁজ নিতে বেশ কয়েকবার চট্টগ্রাম এসে ফিরে যান। এরপর আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করছেন।

আইনজীবীরা জানান, শ্রম আদালতে মামলা করার ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে আরও ৯০ দিন সময় পাওয়া যাবে। শ্রম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ঢাকায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যায়।

চট্টগ্রাম জেলা ছাড়াও প্রথম শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও চাঁদপুর জেলা। চট্টগ্রামের দ্বিতীয় শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলা। অবশ্য ২০১৯ সালের জুন মাসে সিলেটে একটি শ্রম আদালত চালু হয়। কিন্তু এর আগে হওয়া মামলাগুলো চট্টগ্রামেই বিচার হবে।

আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিচারকশূন্যতা, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি, সমন জারিতে দেরি, জবাব দাখিলে আইনজীবীদের বারবার সময় নেওয়া, প্রতিনিধিদের মতামত প্রদানে দেরির কারণে শ্রম আদালতে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মামলার বিচার ঝুলে আছে।

চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালতে এখন ২ হাজার ৫৪৭টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে প্রথম শ্রম আদালতে মামলা রয়েছে ১ হাজার ৮৫৮টি এবং দ্বিতীয় শ্রম আদালতে ৬৮৯টি। এর মধ্যে ১ হাজারের বেশি মামলা রয়েছে, যেগুলো ছয় থেকে আট বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি। দুটি আদালতে এক বছরে (গত বছরের মে থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত) নিষ্পত্তি হয়েছে ২২৭টি। এর আগের বছর নিষ্পত্তি হয়েছিল ৩৫০টি। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মামলা নিষ্পত্তিতে এবার সময় লাগছে বলে জানান শ্রমিক ও আইনজীবীরা।

চট্টগ্রাম জেলা ছাড়াও প্রথম শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও চাঁদপুর জেলা। চট্টগ্রামের দ্বিতীয় শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলা। অবশ্য ২০১৯ সালের জুন মাসে সিলেটে একটি শ্রম আদালত চালু হয়। কিন্তু এর আগে হওয়া মামলাগুলো চট্টগ্রামেই বিচার হবে।

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকার একটি সরকারি বাড়িতে দুটি শ্রম আদালতের কার্যক্রম চলে। গত বুধবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন কর্মচারী আছেন। আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী কেউ নেই। করোনায় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

চাকরি, পাওনা আদায়ের জন্য শ্রমিকদের করা মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা দুঃখজনক মনে করেন শ্রমিক প্রতিনিধি সফর আলী। তিনি বলেন, যত কম সময়ে বিচার পাওয়া যাবে, শ্রমিকদের উপকার হবে।

মালিক প্রতিনিধি মহসিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত মামলা শেষ করার জন্য চেষ্টা রয়েছে। করোনাসহ নানা কারণে নিষ্পত্তিতে সময় লাগছে।

আদালত সূত্র জানায়, দুটি আদালতই কিছুদিন পরপর বিচারকশূন্য থাকায় মামলাজট বেড়ে যায়। অবশ্য এখন দুটি আদালতে বিচারক রয়েছেন। পাঁচ বছর ধরে দুটি শ্রম আদালতে রেজিস্ট্রারও নেই। রয়েছে অফিস সহকারী, নিরাপত্তারক্ষীসহ জনবল-সংকট।

শ্রমিকদের পাওনাসহ নানা দাবি সহজে আদায়ের জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে এগোনোর পরামর্শ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এতে সময় কম লাগবে। দুর্ভোগ কম হবে। মালিক-শ্রমিক দুজনই উপকৃত হবেন। দেশে বিচারক সংকটসহ নানা কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হয়ে যায়। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য মালিক শ্রমিক প্রতিনিধিদের আরও আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ এই অধ্যাপকের।