বঞ্চনা পূরণের আশায় উত্তরখানের বাসিন্দারা

উত্তরখানের মূল সড়কটি বহুদিন ধরে সংস্কারবিহীন পড়ে আছে। এবড়ো–খেবড়ো মাটির রাস্তায় পানি জমে পথচারীদের চলাচল দুরূহ করে তুলেছে (বাঁয়ে)। একই এলাকার অপর একটি ইট বিছানো সড়ক l ছবি: সাহাদাত পারভেজ
উত্তরখানের মূল সড়কটি বহুদিন ধরে সংস্কারবিহীন পড়ে আছে। এবড়ো–খেবড়ো মাটির রাস্তায় পানি জমে পথচারীদের চলাচল দুরূহ করে তুলেছে (বাঁয়ে)। একই এলাকার অপর একটি ইট বিছানো সড়ক l ছবি: সাহাদাত পারভেজ

ছিটমহল বিনিময়ের পর ছিটবাসীর মনে যে আনন্দ জেগেছিল, গত সোমবার উত্তরখানে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো তাদের মনে এখনো ঠিক তেমনই আনন্দ। ছিটবাসীরা মুক্তি পেয়েছিল নিজ ভূমে পরবাসী জীবনের কষ্ট ও গ্লানি থেকে। আর উত্তরখানের বাসিন্দারা মনে করছে, দীর্ঘকালের বঞ্চনার অবসান হতে যাচ্ছে। এবার কেটে যাবে প্রদীপের নিচের অন্ধকার। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে উত্তরখান।
বঞ্চনা এত স্পষ্ট যে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন পড়ে না, আজমপুর রেললাইন পার হয়ে তাকালেই চোখে পড়ে। রেললাইন পর্যন্ত উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের পাকা রাস্তা। রেললাইনের ওপার থেকেই রাস্তা ইটপাতা। পিচের প্রলেপটুকুও পড়েনি (এর খানিকটা অংশ দক্ষিণখান ইউনিয়ন)। সামনে মাইলের পর মাইল এগোতে হবে ওই ইটপাতা পথে। যানবাহনের চাপ প্রচুর। তাই ইটপাতা সড়কের অবস্থা কেমন হতে পারে, তা বলে না দিলেও কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উত্তরখানের কয়েক লাখ বাসিন্দাকে এই পথেই রোজ যাতায়াত করতে হয়।
আজমপুর রেলগেটে থেকে উত্তরখান থানা পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার পথ। এই পথে যেতে আজমপুর কাঁচাবাজার, দক্ষিণ শাহ কবির মাজার, চৈতি চৌরাস্তার মোড় ও রোকেয়া আলম সুপার মার্কেটের সামনে—এই জায়গাগুলোর অনেকখানি অংশ জুড়ে গত শুক্রবারের বৃষ্টির পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। ইটপাতা জলমগ্ন রাস্তায় রিকশা, ইজিবাইকগুলো চলছে ঝুঁকি নিয়ে। অনেককে দেখা গেল জুতা খুলে হাতে নিয়ে কাপড় গুটিয়ে পানি পার হচ্ছেন। শাহ কবির মাজার রোডের নূর ফার্মেসির মো. সজীব, কাঁচাবাজার সুপার মার্কেটের খান ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মো. আলাউদ্দিন, ফায়দাবাদ রোডের মো. ফিরোজসহ অনেকে জানালেন, প্রধান সড়ক ছাড়াও এলাকার ভেতরে মুক্তিযোদ্ধা রোড, দেওয়ান বাড়ি রোড, সংগ্রামী সরণি, বারেক ভান্ডারি রোড এখনো জলমগ্ন। বর্ষায় উত্তরখানে জলমগ্নতা এলাকাবাসীর কাছে এক প্রতিকারহীন দুর্ভোগের উৎস। তবে তারা আশাবাদী, এবার হয়তো অবস্থার উন্নতি হবে। অন্তত প্রধান সড়কটি পাকা হবে, এমনই তাদের বিশ্বাস।
আটিপাড়া চৌরাস্তার মোড়ে কথা হলো সড়কের পাশের ছোট রেস্তোরাঁর মালিক আখতার হোসেনের সঙ্গে। তিনি আদি বাসিন্দা। বাড়ি আরও ভেতরে, চেরাগীপাড়ায়। তিনি খুবই উৎফুল্ল। দীর্ঘকালের বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে খানিকটা উত্তেজিতও হয়ে পড়লেন। বলছিলেন, তাঁর চোখের সামনে এলাকা বদলে গেল। এই ১৯৮০-৮৫ সালের দিকেও আজমপুর থেকে মাটির রাস্তা ছিল। একমাত্র বাহন রিকশা। একজন উঠলে আরেকজনের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। জমির দাম ছিল ৩০-৪০ হাজার টাকা কাঠা। তারপর পিলপিল করে মানুষ বেড়ে গেল। গায়ে গায়ে লাগানো ঘরবাড়ি। রাস্তার পাশের জমির দাম উঠেছে ২০-৩০ লাখ টাকা কাঠায়। আর উন্নতি বলতে শুধু মাটির রাস্তায় ইট বিছানো হয়েছে। মহল্লার ভেতরের সরু গলিগুলোর কোনো পরিবর্তন নেই। এখন সিটি করপোরেশন হওয়ায় গ্যাস-পানির সুবিধা সব এলাকায় পাওয়া যাবে। ওষুধ ছিটানো হবে, কমবে মশার যন্ত্রণা।
উত্তরখান এলাকাটি অনেক বড়। বালু ও তুরাগ নদবেষ্টিত। দুই লাখের ওপর মানুষের বসবাস। এর উত্তর সীমা টঙ্গী-জয়দেবপুরে, দক্ষিণ-পশ্চিমে দক্ষিণখান, পশ্চিমে খিলক্ষেত ও পূর্বে কালীগঞ্জ। অনেক এলাকা যেমন বড়িরটেক, দেবাদিয়া, কাঁচকুড়া, ভাড়ারদি, আমাইয়া, বেতুলি, বাউথার, তেরমুখ ঘাট এসব একেবারে প্রান্তবর্তী এবং বেশ দুর্গমও। রাজধানীসংলগ্ন হলেও এসব এলাকার অবস্থা অজপাড়াগাঁয়ের মতো। আজমপুর রেলগেট পার হলেই পরিবেশ বদলে যায়। মফস্বলের শহরের মতো আবহ চারপাশে। তারপর সামনে এগিয়ে গেলে মনে হয় নিবিড় পাড়াগাঁ।
গ্যাস-পানির সংযোগ আছে কিছু কিছু এলাকায়। তবে সরবরাহ সামান্য। পানির সংকট তীব্র। উত্তরখান থানায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কথা বলতে গেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ সিরাজুল হক বললেন, ‘আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নেই। সমস্যা পানির। আমার থানায় এক মাস ধরে পানি পাই না। ডিএমপির গাড়ি পানি দিয়ে যায়। পাশেই একটি নতুন বহুতল বাড়ি হচ্ছে। জরুরি দরকারে সেখান থেকে পানি আনাই।’
গ্যাসের অবস্থাও একই। গাজীপাড়ার ধর্মীয় শিক্ষিকা কামরুন্নাহার জানালেন, সরা দিন গ্যাস থাকে না। রাত ১০টার পর একবার গ্যাস আসে, ঘণ্টা দুই-তিনেক থাকে। সে গ্যাসেও চাপ এত কম থাকে চুলা জ্বলে মিটমিট করে। এখানে সবাই মূলত সিলিন্ডার গ্যাসই ব্যবহার করেন।
মধ্যপাড়ার আদি বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবদুল মোমেন অভিযোগ করলেন, রাতে সড়কে কোনো বাতি থাকে না। সন্ধ্যার পর থেকে পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে পড়ে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স একটি আছে বটে, তাতে স্বাস্থ্যসেবার মানও তেমন ভালো নয়। উন্নত কোনো স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই এখানে। কোনো নর্দমা নেই, নিষ্কাশন-ব্যবস্থা নেই। অথচ রাজধানীসংলগ্ন বলে লোকে জায়গা কিনেছে আর ঘরবাড়ি তৈরি করেছে। কোনো পরিকল্পিত বসতি গড়ে ওঠেনি। বিশৃঙ্খল ঘিঞ্জি এলাকা। মেয়র আসবেন, এলাকার উন্নতি হবে, এই আশা করছেন তিনিও।
উত্তরখানের সবারই বিশ্বাস ছিল একদিন না একদিন এলাকাটি সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হবে। তা হয়েও গেল। উন্নয়ন কতটা হয়, সেটাই এখন সবার দেখার বিষয়।