বনে বসে সুবীরের ডলার আয়

সুবীরের কাজ তথ্যপ্রযুক্তির আউটসোর্সিং ঘিরে। সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে মধুপুর বনাঞ্চল থেকেই তিনি দেশ–বিদেশের অসংখ্য গ্রাহকের কাজ করে যাচ্ছেন।

বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তরুণদের এভাবেই ফ্রিল্যান্সিং শিখিয়ে চলেছেন সুবীর নকরেক। সম্প্রতি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের রাংরাপাড়ায় বিনা মূল্যের ফ্রিল্যান্সিং সেমিনারেছবি: সংগৃহীত

ছোটবেলা থেকে গ্রামে, বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো সুবীর নকরেক এখনো গ্রামের মায়াতেই বাঁধা পড়ে আছেন। গ্রামটি টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার বনাঞ্চলে। সুবীরের কাজের মাধ্যম ইন্টারনেট। বনের মধ্যে গায়রা নামের এ গ্রামে ইন্টারনেটের গতি খুবই ধীর। কখনো কখনো গাছের ডালে মডেম ঝুলিয়ে, উঁচু টিলায় ল্যাপটপ মডেম নিয়ে গিয়ে ইন্টারনেট সংযোগ পেতে হয়। প্রতিবন্ধকতা পদে পদে। তারপরও থেমে থাকেন না সুবীর ও তাঁর আশপাশের গ্রামের তরুণেরা।

সুবীর নকরেকের কাজ তথ্যপ্রযুক্তির আউটসোর্সিং ঘিরে। সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে মধুপুর বনাঞ্চল থেকে তিনি দেশ-বিদেশের অসংখ্য গ্রাহকের কাজ করে যাচ্ছেন। নিজে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শিখে সফল হয়েছেন। আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে এখন পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তরুণদের ফ্রিল্যান্সিংয়ের নানা কাজ শিখিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন নকরেক আইটি ইনস্টিটিউট। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার তরুণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে গারো তরুণের সংখ্যাই এক হাজার। তিনি নিজেও গারো। এভাবে সুবীর নিজের এবং আরও প্রায় ২০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উপযোগী ও দক্ষ করে তুলেছেন।

ঠিকানা মধুপুর বনের গায়রা

অনেক দিন ধরে গায়রা গ্রামের ফ্রিল্যান্সার সুবীর নকরেকের গল্প শোনার ইচ্ছা। তিনি গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়ার্ডপ্রেস ও ডিজিটাল বিপণন নিয়ে কাজ করেন। গত ২৮ জানুয়ারি দুপুরের দিকে পৌঁছালাম গায়রা গ্রামে।

শুরু হয় সুবীরের সঙ্গে গল্প, তাঁর বাড়িতে। গায়রা গ্রামে ধীরগতির ইন্টারনেট। এখান থেকে নিজের কাজ আর প্রশিক্ষণ চালানো দুরূহ। তাই সুবীর তাঁর নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের শাখা চালু করেছেন ময়মনসিংহের কাঁচিঝুলি, গাজীপুরের ফুলবাড়িয়া, জামালপুরের নান্দিনা এবং ঢাকার বসুন্ধরায়। ২০১৬ সালে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ কর্মশালা থেকে প্রযুক্তিনির্ভর আউটসোর্সিংয়ের কাজ ও ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে ধারণা পান তিনি। চলে যান গ্রামে।

সুবীর বলেন, ‘তখন আমার মনে হলো আমাদের ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যাঁরা অবহেলিত, তাঁদের জন্য কিছু করা প্রয়োজন।’ জানা গেল, এসব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন গারো, চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, সাঁওতাল, রাজবংশী, বর্মণ, কোচ, ওঁরাও, ত্রিপুরা, পাংখো, রাখাইন, খাসি, হাজং, বম ও ম্রো।

সুবীর নিজ গ্রামের তরুণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশায় যুক্তদের বোঝাতে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং বিষয়টি। কী কাজ কীভাবে করলে অর্থ আয় করা যায়, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সে ব্যাপারে ধারণা দিতে শুরু করেন। তারপর আশপাশের গ্রামগুলোতে গিয়ে বিনা মূল্যে সেমিনার ও সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিলেন। তখন আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে দেড় বছরে সুবীরের আয় হয়েছিল ১১ হাজার মার্কিন ডলারের মতো (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা)। সুবীর বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমি পাঁচ হাজার তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।’

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তরুণদের এভাবেই ফ্রিল্যান্সিং শিখিয়ে চলেছেন সুবীর নকরেক
ছবি: সংগৃহীত

একা নয়, সবাইকে নিয়ে ভাবনা

সুবীরের নকরেক আইটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি এই তরুণের আগ্রহ এরও আগে থেকে। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর এক বছরের জন্য ব্রাদার্স অব হলিক্রস সংঘের হয়ে সন্ন্যাসব্রতের জন্য মনস্থির করে ফেলেছিলেন, তখন সুবীর জানতে পারেন ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে। ওই এক বছর ব্রাদার্স অব হলিক্রসে কম্পিউটারেও হাতেখড়ি হয় তাঁর। ২০০৬ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন সুবীর। তখন তাঁর কম্পিউটারপ্রীতি দেখে ব্রাদার্স অব হলিক্রস কর্তৃপক্ষ তাঁকে পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁদের সংঘে কম্পিউটার অপারেটর ও লাইব্রেরিয়ান হিসেবে খণ্ডকালীন চাকরি দেয়।

কম্পিউটার চালানো এবং বিভিন্ন সফটওয়্যারে দক্ষ হওয়ার পর সুবীর নানাভাবে খোঁজ করতে শুরু করেন নিজের পছন্দের কাজ থেকে আয়ের পথ। এর মধ্যে কলেজের পাট চুকিয়ে সুবীর ২০০৯ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্সে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। মাঝখানে পরিবার থেকে বিদেশে চলে যেতেও বলা হয়। কিন্তু সুবীরের মন তাতে সায় দেয় না। নিজের চেষ্টায় কিছু করার তাগিদ বোধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কবিতা লিখতেন সুবীর। জমানো অল্প কিছু টাকা দিয়ে কবিতার বই প্রকাশ করেন। এরপর বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় সেই কবিতার বই বিক্রি করে আয়ও হয়। সেই টাকা দিয়ে কেনেন নিজের প্রথম কম্পিউটার।

ঘরে বসে কম্পিউটারে কাজ করে ডলার উপার্জন করবেন—এ কথা শুনে ২০১০ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু টাকা বিনিয়োগ করেন সুবীর। কিন্তু প্রতারিত হন। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পরপরই জাপানের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো চাকরির প্রস্তাব পান। এক বছর সেখানে কাজ করেন। কিন্তু ২০১৬ সালে ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর জাপানি ওই প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পের কাজ স্থগিত হয়ে যায়। বেকার হয়ে যান সুবীর। তখনই ভাবেন নিজেকেই প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে।

ফিরে যান নিজের গ্রামে। মা-বাবাকে জানান, নিজেদের জমিতে চাষ করবেন। আশপাশের কৃষকদের নিয়ে হতে চান স্বাবলম্বী। কিন্তু সুবীরের মা-বাবা তাঁকে বলে-কয়ে আবার ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। মা-বাবা চেয়েছিলেন ঢাকায় গিয়ে ছেলে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু সুবীর ভর্তি হয়ে যান তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ কর্মশালায়। প্রথমেই ঠিক করেছিলেন, ২০০ ঘণ্টার গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স সম্পন্ন করবেন।

সুবীরের প্রশিক্ষণটা হয়েছিল ২০১৭ সালে। সুবীর বলেন, ‘আমি করপোরেট ব্র্যান্ডিং, ডিজাইন, লোগো, ফ্ল্যায়ার তৈরি, ব্রশিওর, আইডি কার্ড তৈরি ইত্যাদি শিখেছি।’

সুবীর নকরেক
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম কাজে পেয়েছিলেন ৭৫ ডলার

সুবীরের প্রথম কাজ ছিল একটি ফ্ল্যায়ারের নকশা করা। এর জন্য পেয়েছিলেন ৭৫ ডলার। এভাবেই শুরু। এরপর দিনে দিনে কাজ আসতেই থাকে। একসময় সুবীর দেখলেন, একার পক্ষে এত কাজ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তাই পরিচিতজন ও নিজ গোষ্ঠীর তরুণদের ফ্রিল্যান্সিংয়ের ব্যাপারে জানাতে শুরু করেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে কয়েকজনকে প্রস্তুতও করেন। কিন্তু তরুণেরা দক্ষ হয়ে উঠলে অন্য কারও তত্ত্বাবধানে কাজ করতে চান না। সুবীর এবার তাই অন্যভাবে ভাবতে থাকেন। তিনি শুধু নিজের আয় নয়, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে কাজে নেমে পড়েন। সুবীর প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে গিয়ে গিয়ে সেমিনার করাতে শুরু করেন। এভাবেই যাত্রা শুরু হয় নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের।

চার জেলায় প্রশিক্ষণ

বর্তমানে ঢাকার বারিধারা, ময়মনসিংহের কাঁচিঝুলি, গাজীপুরের ফুলবাড়িয়া ও জামালপুরের নান্দিনায় নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের চারটি শাখায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অনলাইনে সারা দেশ থেকে প্রশিক্ষণার্থীরা নকরেক আইটির ক্লাস করেন। ২২টি দেশ থেকেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনলাইনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

সুবীরের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মধুপুরের ইদিলপুরের গারো তরুণী দিনা মৃ। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ডিজিটাল বিপণনের কাজ করেন। প্রথম আলোকে দিনা বলেন, ‘শুরুটা ছিল স্বপ্নের মতো। ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। ২০১৭ সালে নকরেক আইটির মাধ্যমেই ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে ধারণা পাই।’

দিনা মৃ করোনাকালে বিধিনিষেধের দিনগুলোতে বাড়ি থেকেই কাজ করেছেন। তিনি বললেন, ‘একটাই সমস্যা ছিল—ইন্টারনেট। কখনো মাঠে, কখনো বাড়ির উঠানের আমগাছতলায় রাউটার, মডেম ঝুলিয়ে কাজ করেছি। রাতে গ্রাহককে ফাইল পাঠাতে হলে বনে যেখানে ইন্টারনেট পেতাম, সেখান থেকেই কাজ করতাম। বেশি গতির ইন্টারনেট পেলে আমাদের ফ্রিল্যান্সাররা স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারত।’ দিনা মৃ জানালেন, এখন তাঁর প্রতি মাসে গড়ে আয় হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

এভাবেই সুবীর গড়ে তুলছেন প্রযুক্তির দক্ষ কর্মী। যাঁরা নিজেরা হয়ে উঠছেন স্বাবলম্বী।