
মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক প্রবল সৃষ্টিশীল সময়। গানে, কবিতায়, ছবি আঁকায়, সিনেমায় বাঙালির সৃজনশীলতার শতমুখী স্ফুরণ ঘটেছিল ওই উত্তাল সময়েও। এসব সৃষ্টি মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, বিশ্ব জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছে। এ রকমই কিছু সাংস্কৃতিক সৃষ্টির কথা—
স্বাধীনতার প্রবল প্রতিজ্ঞায় উত্তাল মানুষ। প্রতিদিন অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে দেশের ভেতরে গেরিলা অভিযান চালাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সেদিনের সেই অগ্নিগর্ভ, রক্তাক্ত বাংলাদেশে—কখনো অবরুদ্ধ ঢাকা, কখনো নরসিংদীর এক গণ্ডগ্রামে বসে একজন কবি তখন সক্রিয় ভিন্ন অভিযাত্রায়। খুব সন্তর্পণে একের পর এক তিনি আগরতলা বা কলকাতায় পাঠাচ্ছেন অন্য রকম অস্ত্র। শব্দ, বাক্য আর পঙ্ক্তিতে প্রস্তুত করা ঝাঁঝালো সেই অস্ত্রের নাম—কবিতা। আর ওই অজর কবিতাগুচ্ছের একটি ‘স্বাধীনতা তুমি’।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই কলকাতার পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছিল কবিতাগুলো। তারপর ‘স্বাধীনতা তুমি’ কিংবা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’—এসব কবিতাই হয়ে উঠল আমাদের প্রাণের প্রতীক, স্বাধীন বাংলার অনন্য পোস্টার।
তবে লেখা থেকে শুরু করে সেসব গোপনে কলকাতায় ‘পাচার’ করা—পুরো প্রক্রিয়াটি—আজ মনে হতে পারে কোনো রহস্যগল্প। ভয় ছিল, ছিল পদে পদে বিপদের আশঙ্কা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পৃথিবী দেখেছিল ঢাকায় এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। পরে মরণপণ স্বাধীনতার যুদ্ধে সবাই যখন শামিল, যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ নিতে অনেকেই যখন দেশ ছেড়ে ঠাঁই নিচ্ছেন কলকাতা, আগরতলা ও ভারতের অন্যান্য জায়গায়; কবি শামসুর রাহমান সে সময় বাংলাদেশে। আরও অনেকের মতোই অবরুদ্ধ।
২৭ মার্চ কারফিউ ভাঙার পরে ঢাকা ছেড়ে পরিবারসমেত শামসুর রাহমান আশ্রয় নিলেন নরসিংদীর রায়পুরার পাড়াতলীতে, নিজের গ্রামে। এর কয়েক দিন বাদে এপ্রিলের প্রথমার্ধের এক সন্ধ্যায় কবির গ্রামের বাড়িতে উপস্থিত সেদিনের যুবক, আজকের প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। নিজের আত্মজীবনী কালের ধুলোয় লেখাতে এ প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের ভাষ্য: ‘সন্ধ্যেবেলা চাদরে মাথা-ঢাকা একজন যুবক এসে হাজির হলেন আমাদের বাড়ির সামনে। যুবকের মুখটি আবিষ্কার করতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টির মতিউর রহমান। তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ পশ্চিমবঙ্গে যাচ্ছেন আরও ক’জনের সঙ্গে। আমিও যাব কিনা, তিনি জিজ্ঞেস করলেন আন্তরিকভাবে।’
কবির যাওয়া হয়নি। পরিবার-পরিজন রেখে একা সীমান্তের ওপারে কীভাবে যান তিনি?
কিন্তু মাস দেড়েক বাদেই তাঁদের ফিরতে হলো ঢাকায়। সেসব যুদ্ধদিনের অবরুদ্ধ বাস্তবতা বটে। কবির ঢাকা ফেরার পরের দিনগুলোর কথা ধরা আছে তাঁর স্মৃতিলেখায়: ‘চারদিক বিষণ্ন স্তব্ধতায় নিঝুম। দেড় মাস আমরা কেউ ছিলাম না আর এরই মধ্যে উঠোনের ঘাসগুলো এত ডাগর হয়ে গেছে; ফুলের চারাগুলোও বেড়ে উঠেছে অনেকখানি, মনে হলো।...দেড় মাসে আমি এক আলাদা মানুষ হয়ে গেছি। মাথার চুলে পাক ধরেছে, জীবন-মৃত্যুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি গেছে বদলে। একধরনের খাপছাড়া ঔদাস্য যেন আমাকে দখল করে নিয়েছে, অথচ জীবনতৃষ্ণাও দুর্মর।’
এই ‘দুর্মর জীবনতৃষ্ণা’ই শামসুর রহমানকে দিয়ে লিখিয়ে নিল কিছু অমর কবিতা। তত দিনে রাজধানী পুড়ে খাক—এ এক সন্ত্রস্ত দুনিয়া। হত্যা আর রক্ত দরজায় কড়া নাড়ে হররোজ। এই সময় শামসুর রাহমানের কি মনে পড়ে গিয়েছিল একাত্তরের মার্চ মাসে খবরের কাগজে ছাপা হওয়া একটি ছবির কথা, নাকি ছবিটি ছিল তাঁর কল্পনায়? এ ব্যাপারে কবি অবশ্য নিঃসন্দেহ নন। তাঁর ভাষ্যে সেই ছবির রূপ এমন: ‘রাস্তার ধারে একজন গুলিবিদ্ধ মানুষ নিজের রক্ত দিয়ে লিখেছেন শ্লোগান, তাঁর দেশের সপক্ষে, দেশবাসীর সপক্ষে। এই ছবি উজ্জ্বল উদ্ধার হয়ে ফিরে এল আমার কাছে, ফিরে এল বারবার।...একাত্তরের এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে আমাদের গ্রামে এক দুপুরে লিখে ফেললাম “স্বাধীনতা তুমি” ও “তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা” কবিতা দুটি।’

এই কথাগুলো শামসুর রাহমান লিখেছেন তাঁর বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের বাংলাদেশি সংস্করণে (এপ্রিল, ১৯৮২)।
তবে পরে একাধিক সাক্ষাৎকার ও আত্মজীবনীতে তিনি আরও বলেছেন, এপ্রিলের ৭ বা ৮ তারিখের এক দুপুরবেলা পাড়াতলী গ্রামের পুকুরপারে বসে যখন তাঁর মাথায় কবিতাগুলো এল, কাছে ছিল না কোনো কাগজ-কলম। চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে কাগজ ও কাঠপেনসিল চেয়ে নিয়ে একটানে লিখে ফেললেন এই যমজ কবিতা।
একসঙ্গে বেশ কিছু কবিতা লেখার পর ঢাকায় ফিরে শামসুর রাহমান সেই কবিতাবলি তুলে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক ও শাহাদাত চৌধুরীর (বিচিত্রা সম্পাদক) হাতে। শার্ট-প্যান্টের বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো গোপন অস্ত্র—কবিতাগুলো। পরে শিল্পী আবুল বারক আলভীর মাধ্যমে তাঁরা সেগুলো পাঠিয়ে দিলেন ওপারে—প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে।
বিস্ময়ের কথা, একাত্তরের সেই প্রহরে শামসুর রাহমানের নামে কোথাও কোনো কবিতা ছাপা হয়নি! কবিতাগুলো ছাপা হয়েছিল মজলুম আদিব ছদ্মনামে। এ নামের অর্থ নির্যাতিত লেখক। তখনকার প্রেক্ষাপটে স্বনামে শামসুর রাহমানের কবিতা প্রকাশিত হলে তাঁর ক্ষতি হতে পারে। তাই সেসব কবিতা দেশ পত্রিকায় পাঠানোর সময় ছদ্মনামটি দিয়েছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুবই।
একাত্তরের ২১ জুলাই দেশ-এ ছাপা হয় ‘স্বাধীনতা তুমি’। ‘স্বাধীনতা তুমি/ রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।...স্বাধীনতা তুমি/ অন্ধকারে খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক’—স্বাধীনতা ও মুক্তিচেতনার নানা ব্যঞ্জনায় উজ্জ্বল কবিতাটি ছাপার পর থেকেই প্রবল জনপ্রিয়। এর সঙ্গে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতার মধ্য দিয়েও আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পেয়েছে সর্বজনীন সাবলীল মাত্রা।
সেই যুদ্ধদিনে অবরুদ্ধ ঢাকার ‘বন্দিশিবির’-এ বসে লেখা শামসুর রাহমানের কবিতাগুলো নিয়ে আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং তাঁর সহধর্মিণী গৌরী আইয়ুব বন্দী শিবির থেকে নামে বই বের করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন যুদ্ধাবস্থাতেই। ইচ্ছা ছিল যুদ্ধ শেষের আগেই বইটি বেরোবে। কিন্তু পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদে কলকাতার অরুণা প্রকাশনী থেকে ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে বইটি যখন প্রথম প্রকাশ পায়, তত দিনে বাংলাদেশ স্বাধীন। বইয়ে ছিল নামহীন একজনের লেখা ছোট্ট মুখবন্ধ, ‘ঢাকা যখন শত্রুপুরী ছিল, তখন একদিন দুই মুক্তিযোদ্ধার হাতে এসে পৌঁছাল গোপন কিছু পাণ্ডুলিপি। সেই হলো শামসুর রাহমানের কবিতা।...এই কবিতাগুলি যেন বন্দিশালা থেকে তুলে ধরা স্বাধীনতার নিশান।’
হ্যাঁ, রক্তে কেনা আমাদের স্বাধীনতার যে আখ্যান, সেখানে ‘স্বাধীনতা তুমি’সহ মুক্তিযুদ্ধকালে লেখা শামসুর রাহমানের কবিতা অবশ্যই নতুন নিশান উড়িয়েছে, অক্ষরে অক্ষরে যুদ্ধ করেছে বীরের মহিমায়।