বন্ধুত্ব, নির্যাতনের ইতিহাস

বিশ্বকর্মা নামের এক শিল্পী মন্দিরটি তৈরি করেন বলে জনশ্রুতিপ্রথম আলো

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল বাসস্ট্যান্ড চত্বরের পাশে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড। সংকেতে ঐতিহাসিক নবরত্ন মন্দিরে যাওয়ার পথ দেখানো। পাকা সড়ক। আগে থেকেই এর ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা নিয়ে গেলে মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী জানান দেবে নবাব মুর্শিদকুলি খানের শাসনামল।

প্রাচীন এই মন্দিরটি স্থানীয়ভাবে দোলমঞ্চ নামেও পরিচিত। সরস্বতী নদীর কোলঘেঁষা হাটিকুমরুল গ্রামে পৌঁছানোর পর প্রথমেই চোখে পড়বে একটি শিবমন্দির। এরপর দোচালা এক মন্দির। আরেকটু এগোলেই এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় প্রত্ন নিদর্শন নবরত্ন মন্দির। এই মন্দিরের উত্তর-পশ্চিমে ছোট ছোট কয়েকটি দোচালা মন্দির। স্থানটি একসময় ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার স্থান। এখনো এসব মন্দির ঐতিহ্যের ঘোষণা দিচ্ছে।

নবরত্ন মন্দির চিহ্নিত করার সময় কোনো শিলালিপির অস্তিত্ব ছিল না। ফলে এর নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খ ম রেজাউল করিম তাঁর লেখা রায়গঞ্জ: ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি বইয়ে জনশ্রুতির বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন মন্দিরটি ১৬৬৪ সালের দিকে স্থানীয় জমিদার রামনাথ ভাদুড়ী নির্মাণ করেছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন আরও পরে, নবাব মুর্শিদকুলি খানের সময়কাল ১৭০৪-১৭২৮ সালের মধ্যে এটি নির্মাণ করা হয়।

রেজাউল করিমের বই থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রামনাথ ভাদুড়ী দিনাজপুরের তৎকালীন রাজা প্রাণনাথের বন্ধু ছিলেন। ভাদুড়ী তাঁর বন্ধুকে রাজ্যের রাজস্ব পরিশোধে একবার সাহায্য করেছিলেন। এর প্রতিদানে প্রাণনাথ দিনাজপুরের কান্তনগরের কান্তজিউ মন্দিরের আদলে এ নবরত্ন মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। অনেকে মনে করেন, রামনাথ ভাদুড়ী তাঁর নিজস্ব অর্থেই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এমনও শোনা যায়, রাজস্ব দিতে অনিয়ম করায় নবাব মুর্শিদকুলি খান দিনাজপুরের মহারাজাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসার জন্য রামনাথ ভাদুড়ীকে দায়িত্ব দেন। দিনাজপুরে উপস্থিত হলে মহারাজা বৈকুণ্ঠবাসের ভয়ে রামনাথ ভাদুড়ীকে লক্ষাধিক টাকা উৎকোচ দেন। এ টাকা নিয়ে ভাদুড়ী গ্রামে ফিরে আসেন। দিনাজপুরে অবস্থানকালে সেখানকার রাজভবন ও রাজমন্দির দেখার সুযোগ হয় ভাদুড়ীর। এতে তাঁর মনে রাজমন্দিরের মতো কারুকার্যপূর্ণ একটি মন্দির নিজের বাড়িতে তৈরির সাধ জাগে। পরে এ কাজে অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি প্রজাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালান।

মন্দিরের পশ্চিমে একটি বিশাল দিঘি। এ দিঘির কারণে নবরত্ন মন্দিরটির সৌন্দর্য যেন আরও বেড়েছে। ১৮৭৯ ও ১৯৩৮ সালের ভূমিকম্পে মন্দিরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মন্দিরটি সংরক্ষণের ঘোষণ দেয়। মূল নকশা ঠিক রেখে করা হয় সংস্কারকাজ। বছরের প্রায় প্রতিদিনই দেশ-বিদেশের লোকজন নবরত্ন মন্দির দেখতে আসেন। শীতের সময় সমাগম বেশি হয়।