বন উজাড় ও পাহাড় কাটার কারণেই ধস

>* এক–চতুর্থাংশ বনভূমি ধ্বংস হয়েছে * ৬১ শতাংশ ঝরনা শুকিয়ে গেছে * ভূতাত্ত্বিক গঠন নষ্ট করে সড়ক নির্মাণ * পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি নির্মাণ

এক যুগে পার্বত্য চট্টগ্রামের এক-চতুর্থাংশ বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে নির্মাণ করা হয়েছে একের পর এক সড়ক। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে গড়ে তোলা হয়েছে বসতি-অবকাঠামো। এতে ভূতাত্ত্বিক গঠন নষ্ট হয়ে পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে অতিবৃষ্টি যোগ হয়ে বড় ধরনের ধস ও বিপর্যয় ঘটেছে। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল ও বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে এ কথা বলা হয়েছে।

সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশের একটি যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, এক যুগে তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন ধরনের বনভূমি কমেছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৬ হেক্টর। গত মে মাসে তারা এ প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করেছে।

২০১২ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘এশিয়ার দেশগুলোতে পাহাড়ধস ও বনভূমি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ভারতের পূর্বাঞ্চল, নেপালের তরাই উপত্যকা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড়ধসের কারণ হিসেবে বনভূমি ধ্বংস হওয়া বা কমে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত ৮ শতাংশ বেড়েছে। এতে পাহাড়গুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এ ছাড়া পরিবেশবাদীদের পর্যবেক্ষণ বলছে, ১২ জুন মধ্যরাতে তিন পার্বত্য জেলায় একের পর এক পাহাড়ধসের ঘটনায় দেখা যায়, উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত সড়কের দুই পাশের পাহাড়গুলোই বেশি ধসেছে। এসব পাহাড়ে বিভিন্ন স্তরে মাটি ও বালুর মিশ্রণ রয়েছে। এ বিশেষ ধরনের ভূতাত্ত্বিক গঠনকে আমলে না নিয়ে এবং ধস রোধের কোনো ব্যবস্থাপনা না রেখেই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।

ভৌগোলিক বুনন ও গঠন নষ্ট করে সড়ক নির্মাণের পর পাহাড়গুলোর ওপর আরেক বিপদ তৈরি করে বসতি স্থাপনকারীরা। সড়ক নির্মাণের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা পাহাড়গুলোতে বসতি স্থাপন বেড়ে গিয়ে বড় বিপর্যয়ের পরিস্থিতি তৈরি করে। পাহাড় কেটে নানা পর্যটন স্থাপনা ও সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রেও পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও ঝুঁকিকে আমলে নেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির ধরন, পানির প্রবাহ ও আবহাওয়াকে বিবেচনায় না নিয়ে নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প ও বসতি হয়েছে। এর ফলাফল হিসেবে বনভূমি ও পানির উৎসগুলো ধ্বংস হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এমন আর না ঘটে, তিন পার্বত্য জেলা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ভৌগোলিক গঠনের কোনো পরিবর্তন হয়ে গেল কি না, সামনের আরও কোনো বড় বিপর্যয় ঘটার শঙ্কা আছে কি না, তা দ্রুত সমীক্ষা চালিয়ে বের করতে হবে। সেখানকার মানুষদের বাঁচাতে হলে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

পরিবেশবিদেরা বলছেন, পার্বত্য জেলাগুলোর মাটির গঠনবিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে নির্বিচার পাহাড় কাটা। এসব কারণে পাহাড়গুলো শুকনো ও ঝরঝরে হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অতিবৃষ্টির চাপ। এতে পাহাড়ের ওপরের অংশের শক্ত মাটির স্তর বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের মধ্যে ফাটল তৈরি হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ও পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এবার পাহাড়ধসের যে বিপর্যয় ঘটল, তা স্মরণাতীতকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। কয়েক যুগ ধরে নানামুখী ‘অত্যাচারের’ ফলে ওই তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ের সামগ্রিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে বলেও তাঁরা মনে করছেন। জনবসতি এলাকার বাইরে দুর্গম এলাকার অনেক পাহাড়ে তাঁরা বড় বড় ফাটল দেখতে পেয়েছেন।

১২ জুন মধ্যরাতে তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড়ধসে ১৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু রাঙামাটিতেই ১০৫ জন মারা গেছেন।

দেশের তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বনভূমি ও পানির উৎসের পরিবর্তনের ধরন নিয়ে সিইজিআইএস এবং ওয়াটারএইডের একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এখানে ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়েছে। আর ৬১ শতাংশ পাহাড়ি ঝরনা শুকিয়ে গেছে। এর ফলে এই অঞ্চলের পাহাড়ের মাটির বুনন নষ্ট হয়ে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। একই সময়ে ২৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ কৃষিজমি বেড়েছে। এসব কৃষিজমি ভূ-উপগ্রহ থেকে নেওয়া ভূমির স্যাটেলাইট ইমেজ বা ছবির ওপর ভিত্তি করে গবেষণাটি করা হয়েছে।

রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন সড়কের অবস্থা এখন এমনই। যানবাহনের চালক ও পথচারীদের সতর্ক করতে টাঙানো হচ্ছে লাল পতাকা। গতকাল শহরের তবলছড়ি এলাকা থেকে তোলা ছবি l সুপ্রিয় চাকমা
রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন সড়কের অবস্থা এখন এমনই। যানবাহনের চালক ও পথচারীদের সতর্ক করতে টাঙানো হচ্ছে লাল পতাকা। গতকাল শহরের তবলছড়ি এলাকা থেকে তোলা ছবি l সুপ্রিয় চাকমা

এ বিষয়ে ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ে বনভূমি কমে যাওয়ার সঙ্গে পাহাড়ধসের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। গত কয়েক যুগে প্রাকৃতিক বন কেটে গজারি, সেগুন, রাবার ও ফলবাগান তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর শিকড় ছোট ও লতাগুল্ম কম। এতে মাটি আলগা ও শুকনো হয়ে গেছে। অতিবৃষ্টির ফলে মাটি দ্রুত ভেঙে পড়েছে। ফলে পাহাড়ধসের মতো বিপর্যয় ঘটেছে।

বন ধ্বংস ও বনভূমি কমার বিষয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন ধ্বংসের কারণে পাহাড়ধস হয়েছে এই তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। সমতলের অধিবাসীরা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ের মাথায় ঘর তুলেছে। এতে পাহাড়গুলো ন্যাড়া হয়ে এর ভেতরে বৃষ্টির পানি ঢুকে তা ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলছে। আমরা বন বিভাগ থেকে বিভিন্ন সময় পাহাড়ে বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু নানা মহলের অসহযোগিতার কারণে তা পারিনি।’

বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরামের তথ্য বলছে, পাহাড়ে বনভূমি ধ্বংস, ঝরনা শুকিয়ে যাওয়া এবং অপরিকল্পিতভাবে সড়ক ও বসতি নির্মাণের সঙ্গে পাহাড়ধসের হার ক্রমাগত বেড়েছে। ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা এবং কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ৪৯০ জন মানুষ পাহাড়ধসে মারা গেছে।

এ ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জলবায়ু ও দুর্যোগ বিভাগের পরিচালক গওহর নঈম ওয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই ধরনের পাহাড় রয়েছে। একধরনের পাহাড় হচ্ছে শুধুই মাটি বা বালু দিয়ে গঠিত। আর আরেক ধরনের পাহাড়ে বিভিন্ন স্তরে মাটি ও বালুর মিশ্রণ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর-দক্ষিণ দিকে যে সড়কগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, তার দুই পাশের বেশির ভাগ পাহাড় মাটি ও বালুর মিশ্রণে গঠিত। ওই সড়কগুলো পাহাড়গুলোর গঠনবিন্যাসকে দুর্বল করে দিয়েছে। আবার সম্ভাব্য ধস ঠেকানোর জন্য সড়কের দুই পাশে প্রতিরক্ষা দেয়াল ও কাঠামো নির্মাণ করা হয়নি। রাস্তা নির্মাণের পর পাহাড়গুলো কেটে সেখানে বসতি স্থাপন বেড়ে যায়। কোনো সংস্থাই তা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

গওহর নঈম ওয়ারা আরও বলেন, ‘এ ধরনের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। কেননা সেখানে যেভাবে উন্নয়নের নামে সড়ক নির্মাণ, বসতি স্থাপন, বন ধ্বংস ও ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তার পুঞ্জীভূত বহিঃপ্রকাশ আমরা এবারের ধসের মাধ্যমে দেখলাম। এ থেকে যদি আমরা শিক্ষা না নিই, পাহাড়ে আমাদের উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি যদি না বদলাই, তাহলে সামনে আরও বড় বিপদ-বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।’