বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের ‘দিকবদলের দিশারি’ মহিউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএলের প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন আহমেদ
ছবি: মাহরুখ মহিউদ্দিনের ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রকাশনা সংস্থা দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন আহমেদ দেশের মানসম্পন্ন ও সৃজনশীল লেখা বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত করেছেন। তিনি সত্যিকারের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। প্রকাশনাশিল্পে অনন্য পেশাদারি এনেছিলেন। নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। সদ্য প্রয়াত এই প্রকাশকের স্মরণসভায় এভাবেই তাঁর কাজের মূল্যায়ন করলেন বক্তারা।

প্রকাশনাশিল্পে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মহিউদ্দিন আহমেদকে ২০১৪ সালে ‘ইমেরিটাস প্রকাশক’ সম্মাননা দেয় বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি। গত ২১ জুন রাতে মারা যান মহিউদ্দিন আহমেদ।

শুক্রবার সন্ধ্যায় মহিউদ্দিন আহমেদের স্মরণে ভার্চ্যুয়াল সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে অংশ নেন তাঁর সুহৃদ, ইউপিএল থেকে প্রকাশিত বইয়ের লেখক-গবেষক, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিরা। তাঁদের মধ্যে বিদেশি লেখক–অধ্যাপকেরাও ছিলেন।

স্মরণসভার সূচনা বক্তব্য দেন প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদের মেয়ে মাহরুখ মহিউদ্দিন। তিনি অনুষ্ঠান সঞ্চালনাও করেন। পরে সঞ্চালনায় যোগ দেন মহিউদ্দিন আহমেদের আরেক মেয়ে শামারুখ মহিউদ্দিন।

খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষায় বই প্রকাশনায় পথপ্রদর্শক ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি একাডেমিক প্রকাশনার ক্ষেত্রেও ছিলেন পথের দিশারি। তিনি যখন কাজ শুরু করেছিলেন, তখন পারিপার্শ্বিকতা তাঁর অনুকূলে ছিল না। এরপরও অনন্য পেশাদারি নিয়ে তিনি একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা খুব কঠিন। একটি প্রতিষ্ঠান বেশি দিন টেকে না। তিনি বাস্তব অর্থে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রেহমান সোবহান বলেন, সাধারণত ব্যক্তিগত প্রকাশনার ক্ষেত্রেই প্রকাশকদের আগ্রহ থাকে। কিন্তু মহিউদ্দিন আহমেদ প্রাতিষ্ঠানিক ঘরানার গবেষণার বইও প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একাধিক প্রকাশনার কথা উল্লেখ করেন। সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, আর্থিক লাভালাভের বাইরে থেকে মানের দিকে নজর দিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমেদ।

নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ ও তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ওই কলেজে মহিউদ্দিন আহমেদের জ্যেষ্ঠ ছিলেন। সারা জীবন এই সম্পর্ক টিকে ছিল।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, একটা সময় এমন ধারণা ছিল যে ভালো প্রকাশনা বলতে কলকাতা থেকে আসতে হবে। কিন্তু মহিউদ্দিন আহমেদ সেই ধারণা পাল্টে দিলেন। শুধু বইয়ের অঙ্গসৌষ্ঠবের কারণে নয়, বিষয়বস্তুর দিক থেকেও তাঁর প্রকাশিত বই ছিল অনন্য ও বিশ্বমানের।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, মহিউদ্দিন আহমেদ দেশের মানসম্পন্ন, সৃজনশীল, একাডেমিক লেখা ও বই বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত করেছেন। শুধু বাংলাদেশি বই বিশ্বের কাছে পরিচিত করেননি, বিশ্বের জ্ঞানজগতের উল্লেখযোগ্য কাজের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষকে পরিচিত করেছেন। তিনি বাংলা ভাষার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই তিনি প্রকাশ করেছেন নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষার তরুণ পাঠকদের কাছে তুলে দেওয়ার জন্য।

খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, তিনি ইউপিএল নামে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। প্রকাশনাশিল্পে তাঁর পেশাদারত্ব তুলনাহীন। তিনি এমন প্রতিষ্ঠান শুধু গড়ে তোলেননি, নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন।

রওনক জাহান বলেন, মহিউদ্দিন আহমেদের কাজের অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে তিনি পিছপা হননি। তিনি ছেড়ে দেননি।

রওনক জাহান বলেন, ‘আমাদের এখানে লেখক যা দেন, প্রকাশক তা-ই প্রকাশ করে দেন। মহিউদ্দিন আহমেদ যত্ন নিয়ে প্রতিটি লেখা পড়তেন, প্রুফ দেখাতেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতেন। এমন পেশাদারত্ব আমাদের দেশে বিরল। তিনি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন। বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে নিষ্ঠাসহকারে তুলে ধরেছেন।’

যুক্তরাজ্যের বাথ ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক জিওফ উড বলেন, সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মহিউদ্দিন আহমেদের আগ্রহ ছিল। বাংলাদেশকে তিনি সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন সব সময়। তিনি তরুণ লেখকদের ভরসাস্থল।
লেখক থেরসা ব্ল্যানশে বলেন, মহিউদ্দিন আহমেদের মধ্যে অনন্য পেশাদারত্ব ছিল। তাঁর অসাধারণ সৌজন্যবোধ ছিল।

অনুষ্ঠানে মহিউদ্দিন আহমেদের স্মৃতিচারণা করেন অধ্যাপক নিয়াজ রহমান, অধ্যাপক হারুন অর রশীদ, খুশী কবির, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম প্রমুখ।