বাংলাদেশের যে গাছেরা গান গায় অন্য দেশে

মরুভূমির মাটিতে নারকেল আর নিম গাছ জন্মানোর গল্প বলার মতো কিছু না। তবে দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবায় অন্যান্য গাছের সঙ্গে বড় হওয়া কয়েকটি গাছের চেহারা একটু ভিন্ন। তাদের আচরণেও হয়তো বাংলাদেশ বাংলাদেশ ভাব খুঁজে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী মিশনের সদস্যরা পূর্ব-মধ্য আফ্রিকার রুক্ষ মাটিতে যত্নে বড় করছে ওদের। পালা করে পানি দেওয়া, নিয়ম করে গোড়া পরিচ্ছন্ন করা বা কীটনাশক দিতে হয়। অন্য মানুষের ভিন্ন মাটিতে তখন গাছের পাশে বাতাসে উড়ে বাংলাদেশের পতাকা। গাছগুলোর ডাল-পাতায় মিশে আছে আমাদের মফস্বলের বাড়ির ছায়াময় এক উঠোনের গল্প।

মিশন চত্বরে বাংলাদেশের পতাকাকে বৃত্ত করেছে বাংলাদেশের গাছ
ছবি- সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে প্রশ্নের এক পর্যায়ে গাছের বাহক স্বীকার করলেন, দক্ষিণ সুদানের মাটিতে লাগানো গাছগুলো তাঁর মায়ের হাতে তৈরি চারা। মিশনে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার কন্টিনজেন্ট-২০ এর এই প্রকল্প কর্মকর্তা বহন ও রোপণ করলেও এখন গাছগুলো দলের অন্য সদস্যদেরও। ২০০৭ সালে ছুটিতে বাড়ি এসে পুনরায় মিশনে যাওয়ার সময় প্রথমবারের মতো তিনি নিয়েছিলেন কয়েকটি নারকেলের চারা। ২০০৫ সালে দক্ষিণ সুদান স্বায়ত্তশাসনের নিয়ন্ত্রণে আসার বছর দুই পরই প্রথমবারের মতো জুবায় গিয়েছিলেন দায়িত্ব পালনে। তপ্ত বালু মাটির সঙ্গে সদ্ভাবের চেষ্টা আর সংঘর্ষ সহিংসতার বিরুদ্ধে শুরু হলো লড়াইয়ের জীবন। তখনো মূল সুদানের অংশ দক্ষিণাঞ্চল। উত্তরের সঙ্গে উত্তাপ আর গোত্র সংঘাতে বিপর্যস্ত এক জনপদে মিশনের সদস্যদের প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে শান্তি রক্ষার। মাঝে মাঝে তীব্র তাপদাহ আর ধূলি ঝড়ের ঝাপটা উঠে আসে। গনগনে রোদে দগদগে হয়ে রোজ ক্যাম্পে ফেরার জীবন। অনিশ্চিত প্রতিটি দিন-রাত।

জুবায় মিশন ক্যাম্পের পুরো এলাকার মাটি রুক্ষ
ছবি- সংগৃহীত

তিনি দেখলেন, সব দায়িত্ব শেষে পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমাতে গেলে হঠাৎ হঠাৎ বিভ্রম হয়। ভৌগোলিক দূরত্ব বারবার মনে করিয়ে দেয়, যে কোনো সময়ই জীবনের শেষ মুহূর্ত। হয়তো আর কোনো দিন দেখা হবে না বাবা-মায়ের মুখ। অনির্দিষ্ট অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখেন, অপরিচিত খোলা চত্তরে জোছনা বেয়ে নামছে। বস্তুর নির্দিষ্ট আকারের দাগ মুছে যাচ্ছে এমন আলোয়। তখন মানুষের কল্পনা আয়তনের সীমা হারায়। ওই তো একপাশে বসে রান্না করছেন তাঁর মা। ঝুঁকে আছে সামনের বুড়ো আম গাছটা। এইমাত্র টিনের চাল থেকে লাফিয়ে নেমে মাছের লোভে ধারে কাছে দু চক্কর দিয়ে গেলো বাদামি বিড়াল। ঘরের পেছনে নারকেল গাছের পাতা তখন বাতাসে দুলছে বেণির মতো। অন্ধকারের ভেতর মিলেমিশে যায় কল্পনা আর সত্যি গাছের মাথা নেড়ে হ্যাঁ না করার দুলুনি। বুঝতে পারেন, মনের কিছুটা অংশ তীব্রভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফরিদপুরের চৌরঙ্গির পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ছায়া ছায়াময় বাড়ির উঠোনে। অনুভব করলেন, বিদেশ বিঁভূইয়ের এই জীবনে কিছু একটা চাই যা স্পর্শ করলে মনে হয়, আপনজনেরা আছে কাছাকাছি।

২০১২ সালে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হলে জুবা থেকে তুলে নেওয়া হয় বাংলাদেশের কন্টিনজেন্ট। ফেরার সময় স্থানীয়দের দায়িত্বে রেখে আসেন গাছদের।

জুবায় শান্তি মিশনের বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট-২০ এর কয়েক সদস্য
ছবি- সংগৃহীত

আবার ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। দেখেছিলেন, জীবনের লড়াইয়ের স্থানে পরাজিত গাছের যত্ন। মন খারাপ হলো। ওরা শুধু গাছ না, দায়িত্ব শেষে রোজ ফিরে এসে কাছে দাঁড়ালে মনে হতো বাড়ির উঠোন। মা আছেন স্পর্শ করে। ২০২০ সালে পুনরায় জুবায় দায়িত্ব পালন করতে যাওয়ার সময় সহমর্মী হলেন আরেক সহযোদ্ধা বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল একজন। প্রকল্প কর্মকর্তা এবার বেশ আঁটসাট বেঁধে সঙ্গে নিলেন ১২টি নারকেলের চারা আর প্রায় দু শ নিম শিশু বৃক্ষ। তিনি প্রথমে বলছিলেন, সুদানের মাছিগুলোর জন্যই এসব গাছ নিয়ে আসা। দক্ষিণ সুদানের মাছিরা ভীষণ ঘাড় ত্যাড়া। তাড়ালে ফিরে না গিয়ে আরও বেশি গো ধরে ঘুরে আসে। এর জন্য বড় ওষুধ ভালো জাতের নিম গাছ।

দক্ষিণ সুদানে বড় হচ্ছে ফরিদপুর থেকে নেওয়া নিম গাছ
ছবি- সংগৃহীত

এবার দায়িত্ব পালনে কয়েক দিনের জন্য দূরে কোথাও যেতে হলে গাছ শিশুদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে শুরু হলো দুশ্চিন্তা। এর মধ্যে চত্বরে লাগানো হয়েছে আরও বেশ কিছু ফল ফুলের চারা। কন্টিনজেন্টের অন্য সদস্যরা মিলে বের করলেন স্যালাইনের বোতল ব্যবহার করে পানি দেওয়ার পদ্ধতি। ঝুলিয়ে দেওয়া হলো গাছের সঙ্গে। ফোঁটায় ফোঁটায় সিঞ্চন ব্যবস্থায় এবার একেবারে বেড়ে পাকা হয়ে উঠছে ওরা। তাদের সবুজ পাতা, ধীরে ধীরে পুরু হয়ে আসা ডাল জানান দিচ্ছে, শেকড় ছড়াচ্ছে মাটিতে। গাছের অনুভব থাকে। মফস্বলের বাড়ির উঠোনের পরিযায়ী এই গাছ আর মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়েও অটল থাকার শপথ নেওয়া মানুষদের মধ্যে ব্যবধান মুছে যায় প্রবাস জীবনে। এ গাছগুলোর পাশে আছে রোপণকারির নাম ফলক। আলাপের এক পর্যায়ে এ প্রকল্প কর্মকর্তা জানালেন, গাছগুলো যেহেতু এখন তাদের সবার তাই নিজের নাম কোনোভাবেই প্রকাশ করতে চান না তিনি।

স্যালাইনের বোতলে দেওয়া হয় পানি
ছবি- সংগৃহীত

চত্তরে একটু দূরেই বাতাসে উড়ে তিনটি পতাকা। দক্ষিণ সুদান আর জাতিসংঘের মাঝখানে থাকে লাল-সবুজ পতাকাটি। এর আগে দক্ষিণ সুদানে ২৫৬ কিলোমিটারের ‘বাংলাদেশ রোড’ বানিয়েছিল মিশনের সদস্যরা। হাই তিরিরি আর মুন্দ্রি মারিদি গ্রামের মধ্যে তৈরি এই সংযোগ সড়কের ফলে এখন জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষ। এলোমেলো বন্ধুর পথে পা না কেটেই রোজ রোজ বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে পারছে শিশুরা। এই অর্জন গর্ব হয়ে আছে আমাদের জন্য। তবে কয়েকটি শিশু গাছের অবদান এমন মোটা দাগে দেখানোর মতো নয়। বাংলাদেশের মফস্বলের কোনো এক মায়ের হাতের স্পর্শ যখন তাঁর সন্তান হাজার হাজার কিলোমিটার ব্যবধানের মাটিতে ছড়িয়ে দেয়, সে ভালোবাসা আবার কমও কিছু নয়। তখন এ গাছেদের নাম হয়ে যায় শুধু বাংলাদেশ। উগান্ডা, কঙ্গো সীমান্ত সাক্ষী রেখে দক্ষিণ সুদানের জুবায় দ্রুত বড় হচ্ছে এই বাংলাদেশ নামের গাছেরা। কথা বলার ক্ষমতা থাকলে আমরা হয়তো শুনতে পেতাম, তারা প্রাণ খুলে মাথা দুলিয়ে শিশু কণ্ঠে গাইছে সমবেত সংগীত, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।